Monday 11 July 2016

রংনম্বার

(1)
অনিরুদ্ধের মোবাইল বেজে উঠল ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলো একটা অচেনা নাম্বার । হ্যলো বলতেই অন্যপ্রান্ত থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এল,
“হ্যলো তনিমা আছে ?” অনিরুদ্ধের বুঝতে অসুবিধা হোলনা যে এটা রং নাম্বার, ফোনের গলাটা এতই মিষ্টি অনিরুদ্ধ কথা চালিয়ে যাবার জন্য বললো “ না মানে ও তো একটু বেরিয়েছে মোবাইলটা ফেলে গেছে ফিরলে কি বলবো ? ” ফোনের ও প্রান্তর কন্ঠস্বর বল্লো “ ও আচ্ছা ঠিক আছে ও এলে বলবেন রমা ফোন করেছিল ” তারপর ফোনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । অনিরুদ্ধ কিছুতেই গলাটা ভুলতে পারেনা, মেয়েটার নাম জানে, মোবাইল নং জানে ,আর জানে মেয়েটার গলা খুব মিষ্টি । দুদিন পর অনিরুদ্ধ রমার নাম্বারে কল করলো
“হ্যলো রমা বলছেন ? আমি অনিরুদ্ধ ” রমা বল্লো “কে অনিরুদ্ধ ?” অনিরুদ্ধ বললো “ প্রথমেই বলি আমি অত্যন্ত দুঃখিত সেদিন আপনাকে মিথ্যে হয়রানী করার জন্য ” তারপর অনিরুদ্ধ পুরো ব্যপারটা রমাকে বুঝিয়ে বলার পর রমাতো প্রথমে বেশ রেগেই গেল, পরে অবস্য রাগ টাগ ভুলে হেসেই ফেললো । পরদিন রমা নিজেই ফোন করলো বেশ অনেক কথাই হল ।
এখন রোজ নিয়ম করে অনিরুদ্ধ একবার সকালে আর রাতে ফোন করে, রমা অবশ্য রোজ না হলেও এক দুদিন ছাড়া দুপুরের দিকে ফোন করে। আপনি ছেড়েছে দুজনেই এখন তুমি তুমি সম্পক । অনিরুদ্ধ রমার দেখা হয়নি এখনও, নাইবা হোক দেখা তবু কোথাও যেন প্রেম বাসা বেঁধেছে । একদিন ঠিক হল অফিস ছুটির পর কফি হাউসে দেখা করবে, কিন্তু দুপুরে রমা ফোন করে বললো “ আজ হবেনা বুঝলে মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ এখনি দেশের বাড়ি যেতে হবে ” অনিরুদ্ধর মন খুব খারাপ হয়ে গেল ছয় মাস রমার সাথে ওর সম্পক একদিন ও দেখা করতে পারলো না । রমা থাকে গড়িয়ায় একটা মেসএ ঠিকানা ও জানে অনিরুদ্ধ ,কিন্তু মহিলাদের মেস হুট করে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে যায়নি কোনদিন।
পরদিন ফোন এলোনা রমার ,অনিরুদ্ধ সকাল থেকে কয়েকবার ট্রাই করেছে কিছুতেই ফোন লাগছে না । রমা অবশ্য বলেছিল ওর দেশের বাড়ীতে নেটওয়াক এর একটু সমস্যা আছে , কিন্তু ও তো জানে অনিরুদ্ধ চিন্তা করবে ।
পাঁচ দিন কেটে গেল কোনো খবর নেই রমার ,মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবে ,তারপর না হয় গড়িয়ার মেসে যোগাযোগ করে রমার দেশের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সেখানেই যাবে এমনটাই ভাবলো অনিরুদ্ধ । রমার নাম্বারে ডায়াল করতেই রিং হচ্ছে ...উফঃ বাঁচলো অনিরুদ্ধ, রমা তাহলে ফিরেছে আজ অনিরুদ্ধ বলবেই তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব, ফোন বেজে চলেছে “হ্যলো কে ?” ওপ্রান্তে এক পুরুষের গলা । অনিরুদ্ধ বললো “রমাকে একটু ফোনটা দিননা ?” ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো “আপনি বোধহয় ভুল নম্বর ডায়েল করেছেন, কারন রমা বলে এখানে কেউ থাকেনা ” ফোনটা কেটে দিলেন ভদ্রলোক। অনিরুদ্ধর শরীর অবস হয়ে আসছে আবার সে রমার নম্বর ডায়াল করল সেই ভদ্রলোক ফোন ধরে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বললো “আপনি কি বাংলা ভাষা বোঝেন না? বলছি তো রমা টমা বলে কেউ থাকে না এখানে” অনিরুদ্ধ খুব ঠান্ডা মাথায় বললো “ আপনাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে আমার নেই আসলে ৯৬৮১২৩৫৭৫৭ এই নাম্বারে গত ছয় মাস যাবৎ আমি রমার সাথে কথা বলে আসছি তাই আজ ওকে খুঁজছি এই নম্বরে” ভদ্রলোক বললেন “সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমার নাম অনন্ত সোম পেশায় অধ্যাপক আর গত পাঁচ বছর ধরে ৯৬৮১২৩৫৭৫৭ নম্বরটি ব্যবহার করি আর কিছু সাহায্য লাগলে বলবেন” উনি ফোন রেখে দিলেন । অনিরুদ্ধ কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা ,হঠাৎ মনে হল ভদ্রলোক ঠিক বলছে কিনা যাচাই করা উচিত, অনিরুদ্ধর এক বন্ধু টেলিকম এ চাকরী করে বেশ উচু পোস্ট ,ওকে বললে কাজ হবে। অনিরুদ্ধ সেই বন্ধু কে রমার নম্বর দিয়ে বললো একটু যাচাই করতে । আধ ঘন্টা পর সেই বন্ধু ফোন করে যা বললো তাতে অনিরুদ্ধর যেন শরীর আর মন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, ভদ্রলোক যা যা বলেছিলেন অনিরুদ্ধকে ফোনে, মিলে গেল ওর বন্ধুর কথার সঙ্গে । বিকেলে গড়িয়ার মেসের ঠিকানায় অনিরুদ্ধ গিয়ে যা শুনলো তাতে অনিরুদ্ধর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, মেসের মালকানী বললেন ছয়মাস আগে রমা বলে একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সেই থেকে মেস খালি, নতুন কেউ আসলে দুদিন থেকেই ভয়ে পালিয়ে যায়।
অনিরুদ্ধ তার মোবাইল এর ইনবক্স এ রমার পাঠানো এস এম এস গুলো খুঁজতে লাগলো একি?.... এস এম এস গুলো কেউ যেন নিপুণ হাতে ডিলিট করে দিয়েছে ।
(2)
অনিরুদ্ধর কোথাও যেন একটা খটকা লেগে আছে ছমাস প্রতিদিন রমার সাথে অন্তত দিনে দুবার কথা হত হঠাৎ অনন্ত সোমের আবির্ভাব আর রমার আত্মহত্যা দুটোই যেন অনিরুদ্ধর অবিশ্বাস্য । বছরখানেক হল একটি বিদেশী বীমা কোম্পানির ম্যানেজার অনিরুদ্ধ । অত্যন্ত মিশুকে প্রকৃতির অনিরুদ্ধ ভূতে ভয় পাওয়ার মতো দূবল চিত্তিরও ছিল না ।
সেদিন রাতে অনিরুদ্ধর কিছুতেই ঘুম আসছে না , রমার গলাটা তার কানে যেন এখনও বাজছে । সত্যই অনিরুদ্ধ বোধহয় রমা কে না দেখেই ভালবেসে ফেলেছিল । অনিরুদ্ধ মনে করার চেষ্টা করল রমার সাথে কথোপকথন গুলো, যতবারই অনিরুদ্ধ দেখা করার কথা বলেছিল রমা নানাভাবে এড়িয়ে গেছে, এমনকি ফেসবুক প্রোফাইল চাইতে রমা বলেছে ওর নাকি ওসবের সখ নেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাট করতে নাকি ওর ভালো লাগেনা ।
একদিন একটা মজার খেলা খেলছিল দুজনে ফোনে ফোনে কাকে কেমন দেখতে আন্দাজে বলতে হবে । প্রথমে অনিরুদ্ধ বললো “তুমি রোগা রোগা ফসা কোঁকানো চুল চওড়া কপাল মিস্টি দেখতে লম্বায় ধর ৫’৪” টার হবে” রমা শুনেই খিলখিল করে হেঁসে উঠে বললো “এই যে মশাই এটা কার বননা দিলে শুনি ? আমি মোটেই অমন দেখতে নই আমি খুব সাদামটা বরং ঠিক তোমার বননার উল্টোটা ” অনিরুদ্ধ বললো “ মিথ্যেকথা !! চিটিং!! ” রমা বললো “বেশ দেখা হলে আফসোস কোরোনা ” এবার অনিরুদ্ধ বললো “এবার তোমার পালা ” তারপর রমা যা বললো অনিরুদ্ধর চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছিল ।
রাত প্রায় তিনটে কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না অনিরুদ্ধ, হঠাৎ মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো, অনিরুদ্ধ অবাক এত রাতে কে ম্যাসেজ করলো ? অনিরুদ্ধ ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলো একি ??? .. রমার নম্বর থেকে ম্যাসেজ ? তাড়াতাড়ি ম্যাসেজটা খুলে দেখলো তাতে লেখা “ আমি আছি, তোমার কাছেই আছি, ভয় নেই ,ঘুমোও”........
(3)
অনিরুদ্ধর টেলিকম এর বন্ধু সতীনাথের দেওয়া অনন্ত সোমের ঠিকানা হলো ১২/৩ এ, রজনী রায় সরনী , ভবানীপুর কলিকাতা ৭০০০২৬ । অনিরুদ্ধ দেরি না করে মানষকে ফোন করলো, মানষ অনিরুদ্ধের অফিসের জুনিয়ার অনিরুদ্ধকে দাদার মত ভালোবাসে আর তা ছাড়া ও রমার ব্যপারটা পুরোটাই জানে । “ মানষ দশ মিনিটের মধ্যে টালিগন্জ্ঞ মেট্রো স্টেশনে চলে আয় আমি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবো ” “কি ব্যাপার কি অনিদা ?” মানষ বললো । “পরে সব বলবো সময় নেই ” বলে অনিরুদ্ধ ফোন রেখে দিলো।
মানষের বাড়ি মুর এভিনিউ মেট্রো স্টেশন পৌছতে দশ মিনিটই লাগলো । গাড়িতে উঠে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে মানষ বললো “কি ব্যাপার কি ?” অনিরুদ্ধ সংক্ষেপে সব বললো মানষকে।
ঘড়িতে সকাল ৭টা বাজে অনন্ত সোমের ঠিকানা খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না অধ্যাপক মানুষ হয়তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েন , কলিংবেল দু তিনবার বাজার পর দরজা খুললেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। অনিরুদ্ধ বললো “অনন্ত বাবুর সাথে একটু দরকার ছিল” ভদ্রলোক বললেন “আমিই অনন্ত সোম কি ব্যাপার বলুন তো ” অনিরুদ্ধ হাতজোড় করে নমস্কার করে বললো “আমি অনিরুদ্ধ রায় গতকাল রমার খোঁজে আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম অপরাধ নেবেন না খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে সকালে এসেছি ” অনিরুদ্ধ বলে চলে “গতকাল রাত তিনটে নাগাদ আমার মোবাইলে আপনার নম্বর থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে” অনন্ত সোম অনিরুদ্ধকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো “দাঁড়ান দাঁড়ান কি বলছেন আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না ? আপনি কাল আমায় ফোন করেছেন ? রমা ? আমার ফোন থেকে ম্যাসেজ ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?” অনিরুদ্ধ বললো “আপনার মোবাইল নম্বর ৯৬৮১২৩৫৭৫৭ তো ? আপনি প্রফেসর সোম তো ?” অনন্ত বাবু বললেন “প্রফেসর ? কি আবোল তাবোল বকছেন ? আমার পাড়ায় একটা মুদিখানা দোকান আছে আর নম্বর এর কথা যদি বলেন মাস আষ্টেক আগে আমার মোবাইলটা হারিয়ে যায় , আমি থানায় একটা ডাইরী ও করেছিলাম কিন্ত বাবা টেলিফোন কোম্পানিকে সেটা জানানো হয়নি আমার ফোন তেমন কাজে লাগেনা বলে একটা চলতি নম্বর নিয়ে কাজ চালাচ্ছি” অনিরুদ্ধ বেশ অবাক দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো “আশ্চর্য !!! আপনি প্রফেসর সোম নন ? তাহলে আপনার ফোনটা নিশ্চই অন্য কেউ গত ছমাস ধরে ব্যবহার করছে” অনিরুদ্ধ বলে চলে “অনন্ত বাবু দয়া করে আপনি টেলিফোন কোম্পানিতে জানান যাতে ওরা আপনার সিমটা লক করে দেয় আর আমাকে যদি আপনার পুলিস ডাইরির একটা কপি দেন তাহলে হয়তো আমার একটু উপকার হয়” অনন্ত বাবু বললেন “নিশ্চই এ তো খুব খারাপ ব্যাপার আপনারা একটু দাঁড়ান আমি এখনি এনে দিচ্ছি ” মিনিট পাঁচেক পর অনন্ত সোম কাগজ নিয়ে ফিরে এলেন । মানষ কাগজটা নিয়ে দৌেড় জেরক্স করে নিয়ে এলো । তারপর ওরা দুজনেই অনন্ত সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠলো। সিটে বসেই অনিরুদ্ধ বিদ্যুৎগতিতে মোবাইলটা তুলে রমার নাম্বার ডায়াল করলো , ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো রেকডেড ভয়েস “দ্যা টেলিফোন নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ কারেন্টলি সুইচড্ অফ” .....
(4)
দুপুরে অফিসের ক্যন্টিনে লান্চ করতে করতে মানষ অনিরুদ্ধকে বললো “আচ্ছা অনিদা তোমার কি মনে হয় এটা নিছক কেউ তোমার সাথে মজা করছে? ” অনিরুদ্ধ স্যন্ডরুইচে একটা কামড় দিয়ে মাথা নেড়ে বললো “মোটেও না যদি কেউ মজাই করবে তাহলে দীঘ ছমাস ধরে প্রেমের অভিনয় করবে না ” মানষ বললো “তাহলে প্রফেসর বলে যে তোমায় পরিচয় দিল সে কে ?আর রমাই বা কে?” অনিরুদ্ধ বললো “দেখ মানষ যে যাই বলুক রমা মারা যায়নি আর এটা কোনো প্রেতাত্মা কাজ নয় সেটা কিন্তু পরিস্কার ” হঠাৎ মানষ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো “আচ্ছা অনিদা গড়িয়ার যে মেসের কথা তোমায় রমা বলেছিল তুমিতো ওখানে খোঁজ নিয়েছিলে ওরা তোমায় আত্মহত্যার কথা বলেছিল ঠিকই তুমি কি ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়েছিলে ? সত্যই কেউ ওই বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিল কিনা ? মানে থানায় খোঁজ করা ? বা আশপাশের দোকান বা বাড়িতে খোঁজ নেওয়া ?” অনিরুদ্ধ বললো “ঠিক বলেছিস আমি তখন এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম তাই ওসব আমার মাথায় একদম আসেনি” মানষ বললো “ জানো অনিদা আমার মনে হয় রহস্যের সমাধান ওই মেসবাড়িতেই লুকিয়ে আছে” বেসিনে হাত ধুয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে ফেরার সময় অনিরুদ্ধ আর মানষ একটা অদ্ভূত জিনিস লক্ষ্য করলো ক্যন্টিনের মনুদা বেশ পুরোনো লোক যে টেবিলে ওরা লান্চ করছিল সেই টেবিলটা পরিস্কার করতে করতে অনিরুদ্ধর মোবাইল হাতে নিয়ে কি যেন করছে । হঠাৎ ওদের ফেরত আসতে দেখে মোবাইলটা জেয়গায় রেখে দিয়ে তার পরই প্লেট গ্লাস তুলে নিয়ে চলে গেল। মানষ আর অনিরুদ্ধ চোখ চাওয়াচায়ী করলো । পয়সা দেবার সময় মানষ মনুদাকে বললো “অনিদার মোবাইলে কি দেখছিলে ?” মনুদা খুব সরল সাদামটা লোক এক গাল হেসে বললো “কি সুন্দর টিভির মত মোবাইল তাই একটু দেখছিলাম” অনিরুদ্ধ বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বললো “চল মানষ একটু বেরোতে হবে । ”
গাড়িতে উঠে মানষ বললো “গড়িয়া থানা চলো অনিদা আগে পুরো ব্যপারটা একবার ওদের জানাই তারপর ওদের সাহায্যে নিয়ে যদি কিছু করা যায়”
গড়িয়া থানার মেজবাবু সুনীল পাল মোটা গোঁফ বেশ জাদরেল চেহারা পুলিস বলে মানায় কিন্ত । বাজখাই গলায় বললেন “কি ব্যাপার ? ” অনিরুদ্ধ গোড়ার থেকে সব ঘটনা বললো পালবাবুকে। পাল বাবু শুনে বললেন “ইন্টারেস্টিং !! ভূত ?? কলকাতা শহরে মানুষের থাকার জায়গা নেই আবার ভূতের আমদানি ..” তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন “ কবে হয়েছে আত্মহত্যা” অনিরুদ্ধ বললো “স্যার ভদ্রমহিলা বলেছিল মাসছয়েক আগে গলায় দড়ি কেশ” পালবাবু কেস ডাইরির ফাইলটা ঘাঁটতে লাগল অনেক্ষন ঘাঁটার পর বললো “না তেমন কোন ঘটনা দেখছি না যে কটা কেস গলায় দড়ির আছে বেশিরভাগটাই ছেলে দু একটা কেস যাও আছে তাও স্কুল ছাত্রীর । যাক আপনারা ডাইরি সেক্সানে গিয়ে একটা জেনেরাল ডাইরি করুন পুরো ঘটনার উল্লেখ করে আর অনন্ত সোমের মোবাইল হারানোর ডাইরি নম্বরটাও উল্লেখ করবেন তারপর দেখছি এই ভূত পেতনীর রহস্যটা সমাধান করা যায় কিনা, আর হ্যাঁ আপনার নাম, বাবার নাম ,পুরো ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সব লিখবেন প্রয়োজন হলে আমি ফোন করবো ” অনিরুদ্ধ রিপিট লিখিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে বললো “ মনে হয় পালবাবু কেসটাতে বেশ রস পেয়েছে বেশ উদ্যোগী বলে মনে হল দেখা যাক কি করেন”
মানষ সেদিন অনিরুদ্ধর ফ্ল্যাটে থেকে গেল , ফ্ল্যাটে অনিরুদ্ধ একাই থাকে । সন্ধ্যার দিকে অনন্ত সোম একবার ফোন করে অনিরুদ্ধকে জানিয়েছিল যে সে টেলিফোন কোম্পানিকে জানিয়ে সিম লক করে দিয়েছে ।
হুইসকির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে রমার সাথে নানান মজার কথাবার্তা গুলো মানষকে বলছিল । অনিরুদ্ধ কিছুতেই বুঝতে পারছেনা রমা এমন প্রতারণা করলো কেন । রাত দশটা বাজে তিন পেগ করে হুইসকি খাওয়া শেষ, হালকা আমেজে মাথাটা ঝিমঝিম করছে অনিরুদ্ধর, রমার সাথে হওয়া কথোপকথন মনে পড়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় । অনিরুদ্ধর মোবাইল বেজে উঠলো, একটা অচেনা নম্বর থেকে কল । এক ঝটিকায় যেন নেশাটা তলিয়ে গেল, অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর এক অদ্ভূত উত্তেজনা আবার কে ফোন তুলে বললো “হ্যালো ” ওপার থেকে ভেষে এলো “আমি ইনেস্পেকটার সুনীল পাল বলছি আপনাদের একটু গড়িয়া থানায় আসতে হবে এখনই ” ....
(5)
গড়িয়া থানা পৌছতে পৌছতে প্রায় ১১টা বাজলো, পথে একটা পানবিড়ির দোকান থেকে মাউত ফ্রেস্নার কিনে দুজনে মুখে দিল । উত্তেজনায় হুইসকির নেশা কোথায় উদাও হয়ে গেছে দুজনেরই । থানায় ঢুকে পালবাবুর ঘরে যেতেই ওরা দেখলো মেসের মালকানী চেয়ারে বসে । পালবাবু অনিরুদ্ধকে চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললো “বসুন ” ওরা দুজনে বসে পড়ল, তারপর অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো “ইনি হলেন গিয়ে আপনার কি বলে ভূতের মাসী কমলিকা পাত্র আর ওই দিকে লকাপে গিয়ে দেখুন আপনার ভূতের মেসো কেমন বসে রাম নাম করছে গিয়ে দেখুন চিন্তে পারেন কিনা ” অনিরুদ্ধ আর মানষ প্রায় দৌড়ে লকাপের বাইরে গিয়ে দেখলো “একি !!এতো মনুদা !!” অনিরুদ্ধ আর মানষ প্রায় একসাথে বলে উঠলো । পালবাবু বললেন “সেকি ?চেনেন নাকি ?” অনিরুদ্ধ বললো “আমাদের অফিসে ক্যান্টিন চালায় অনেক দিনের পুরোনো লোক পালবাবু আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে উনি অমন লোক নন ” পালবাবু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন “তাইনাকি ? ২৬ বছর পুলিসে চাকরি করছি মাল চেনে দারগাবাবু শালাকে অনেক কাঠকর পুড়িয়ে ধরেছি , অনেকদিন ধরে খুজছিলাম,চোরাই মোবাইল কেনা বেচা করে,আর লোককে বলে ক্যান্টিন চালাই, ভাবলো নাম মনোরঞ্জন পাত্র” অনিরুদ্ধ কিছু ভাবতে পারছে না কেন মনুদা আর তার স্ত্রী তার সঙ্গে এরকম করল। পালবাবু বললেন“আর এই যে ওনার স্ত্রী কমলিকা দেবী একটা লেডিস মেস চালায়,ওনার মুখে তো কোনো সাড়াই নেই,সব নাকি ওনার স্বামী আর সুজাতা জানে” অনিরুদ্ধ বললো “সুজাতা ? সে আবার কে ? ” পালবাবু বললেন “ ওইতো আপনার ভূত যে আপনার সাথে এত দিন কথা বলেছে আসছে সেও আসছে লোক পাঠিয়েছি আধ ঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বে” অনিরুদ্ধ পালবাবুর কাছে জানতে চাইলো মনুদা কিছু বলেছে কিনা । পালবাবু বললেন “ও বললো যা বলার নাকি সুজাতাই বলবে ”
মিনিট পনেরো পর দুজন লেডিস কনস্টবল একজন মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । মহিলার পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ মুখটা ওড়না দিয়ে ঢাকা । অনিরুদ্ধ আর মানষ অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলো । অনিরুদ্ধর কেন জানিনা মনে হচ্ছে এই চেহারার সাথে আগে কোথাও পরিচয় হয়েছে । পালবাবু বললেন “ কই দেখি ওড়নাটা খুলুন কেমন ভূত একবার দেখি ” কথাটা বলতেই সুজাতা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, কমলিকা দেবী চেয়ার ছেড়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো সুজাতাকে , তারপর কমলিকা দেবী আস্তে আস্তে সুজাতার মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিলেন। এক কিম্ভূতকিমাকার মুখ বেরিয়ে এলো, মাথায় এক ফোঁটা চুল নেই , মুখটা পুরোপুরি পোড়া, চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে , কিন্তু সেই চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছে । যে কেউ এই চেহারা দেখলে অন্ধকারে ভয় পাবেই । অনিরুদ্ধ চেঁচিয়ে বলে উঠলো “ ও নো !! ও নো !! সু জা তা !! ” বলে কেঁদে ফেললো।
(6)
অনিরুদ্ধ তখন বি কম সেকেন্ড ইয়ার এর ছাত্র, কলেজের নবীন বরন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, হাতে পরিবেশনকারীদের লিস্ট নিয়ে একে একে কলাকুশলীদের নাম ডাকছে । “সুজাতা বোস বি কম ফাস্ট ইয়ার এখন আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করবে ” অনিরুদ্ধ মাইকে এনাউন্স করল। স্টেজে এলো এক অপূর্ব সুন্দরী ,হাততালিতে হল ভেঙে পরল,পেছন থেকে বেশ কিছু ছেলে সিটিও মারলো,গান তখন শুরুই হয়নি। অনিরুদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো,রোগা রোগা ছিপছিপে ফরসা স্টেপকাট চুল কি অপূর্ব মুখশ্রী ,সুজাতা ডান হাত দিয়ে মুখের সামনে এসে যাওয়া চুলটাকে সরিয়ে দিয়ে সবাই কে নমস্কার করে গান শুরু করলো“তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে প্রাণে......” গানের শেষে হল ফেটে পড়ল হাততালি আর সিটিতে। যেমন অপূর্ব দেখতে তেমনি অপূর্ব গলা। অনুষ্ঠানের শেষে অনিরুদ্ধ সুজাতার কাছে এসে বলল “আমি তোমার গান শুনে মুগ্ধ ,কোথায় থাক ?” সুজাতা লাজু হাসি হেসে বলল “গড়িয়া,....তুমিও তো বেশ ভালো সঞ্চালনা করলে”।
তারপর থেকে রোজই অনিরুদ্ধ সুজাতার সাথে কথা বলে। একদিন সুজাতা এসে বললো “অনিদা আমাকে এই অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দেবে কিছুতেই ব্যালেন্স শিট মেলাতে পারছি না” অনিরুদ্ধ একটা ফাঁকা ক্লাসঘরে গিয়ে সুজাতাকে অঙ্কটা করে দিল। সুজাতা ভীষন খুশি হয়ে “থ্যাঙ্কস !!! ” বলতেই অনিরুদ্ধ সুজাতার হাত ধরে বললো “আমি তোমাকে ভালোবাসি সুজাতা ” সুজাতার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুচকি হেসে “ধ্যাত ” বলে মাথা নিচু করে ক্লাসঘর থেকে চলে গেল। ঠিক তার পরদিন সুজাতা একটা বই অনিরুদ্ধকে দিয়ে বললো “৫৬ পৃষ্ঠার অঙ্কটা একটু দেখে রেখো আমি ইকোনমিক্স এর ক্লাস করে আসছি , দেখিয়ে দিও” । অনিরুদ্ধ ৫৬ পৃষ্ঠা খুলে দেখল একটা ছোট্ট কাগজে লাল কালি দিয়ে লেখা “আমিও”। অনিরুদ্ধ সুজাতার প্রেম গাড়ো থেকে আরো গাড়ো হতে লাগল।
বাপ মা মরা সুজাতা মাসী , মেসোর কাছে মানুষ। অনিরুদ্ধ কোনোদিন সুজাতার বাড়ি যায়নি কারন সুজাতাই মানা করতো। ও বলতো মেসো খুব গরিব কষ্ট করে আমায় লেখাপড়া শেখাছে, যদি বঝে যে কলেজে গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে প্রেম করছে হয়তো মনে দুঃখ পেতে পারে। তাই সুজাতা ঠিক করেছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর না হয় মেসো মাসীর সাথে অনিরুদ্ধর পরিচয় করাবে। সবই ঠিক চলছিল নিয়মমাফিক কিন্তু একদিন হঠাৎ, অনিরুদ্ধ খবর পেলো কালীপূজোয় তুবড়ী জ্বালাতে গিয়ে তুবড়ী ফেটে সুজাতার পুরো মুখ ৮০ % পুড়ে গেছে পি,জিতে ভরতি । এক বন্ধু দেখে এসে যা বললো তাতে অনিরুদ্ধর মনে হল দেখতে না যাওয়াই ভালো। সুজাতার অনেক বন্ধু অনিরুদ্ধকে এসে বলেছিল “তোমায় সুজাতা দেখতে চেয়েছে অন্তত একবারটি অনিদা ” স্বার্থপর অনিরুদ্ধ বিদ্রূপ সুরে বলেছিল “আমি যে সুজাতাকে ভালোবাসতাম সে তো ভূত হয়ে গেছে , আমার আবার ভূতে ভীষন ভয় , তাই ভূতের সাথে নো প্রেম”
তারপর থেকে আর কোনোদিন সুজাতার সাথে অনিরুদ্ধর দেখা হয় নি।
(7)
রাত তখন ১২টা বাজে মেজবাবুর ঘরে উপস্থিত সবাই, সুজাতা চোখ মুছে বলতে লাগল “আমার মেসোকে ছেড়ে দিন স্যার ওনার কোনো দোষ নেই সব কিছুর জন্য এই পোড়ামুখিই দায়ী। ” সুজাতা বলে চললো “পি জিতে প্রায় ছমাস পড়েছিলাম, একে একে সব বন্ধুবান্ধবই প্রায় যে যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেল শুধু তনিমা ছাড়া ও সকাল বিকল আমার খোঁজ রাখতো আর অনিরুদ্ধর সব খুঁটিনাটি খবর আমায় দিতো, কি করে কোথায় যায় কারোর সাথে প্রেম করে কিনা সবকিছু । দামি দামি ঔষধ আর মলম দিয়ে চামড়ার ওপরের ঘা সুখোচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু ভেতরের ঘা দিন দিন আরো দগদগে হয়ে উঠছিল। ঔষধ আর মলম কিনে কিনে আর পেরে উঠছিলো না মেসো তাই হয়তো আমার জন্য মোবাইল কেনা বেচা করতো, আমার মেসো অমন লোক নয় স্যার” ঘর বেশ থমথমে হয়ে গেছে, সবাই সুজাতার দিকে তাকিয়ে । সুজাতা বলে চলে “অনিরুদ্ধকে খুব দেখতে ইচ্ছা করতো, খুব কথা বলতে ইচ্ছা করতো মাঝে মাঝে একা একাই কাঁদতাম। মাসী মেসোকে বললাম একদিন অনিরুদ্ধর কথা, মেসো বলেছিল তনিমা যদি একবার চিনিয়ে দেয় অনিরুদ্ধকে দূর থেকে ,তাহলে অনিরুদ্ধকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে আসবে আমার কাছে । মাস ছয় আগে তনিমা দূর থেকে দেখিয়েছিল অনিরুদ্ধকে ওর বাড়ির সামনে ফিরে এসে মেসো বলেছিল সম্ভব নয় কারন মেসো যে অফিসে ক্যান্টিন চালায় সেই অফিসেরই ম্যানেজার অনিরুদ্ধ, কিছু বললে ওর ইমেজ খারাপ হতে পারে। তাই ঠিক করলাম ওর সাথে একটু কথাই বলে নিই , ফোন নম্বর তনিমাই এনে দিয়েছিল। পরে ভাবলাম সুজাতা বলে ওর সাথে কথা বললে যদি ও আবার হারিয়ে যায় তাই ঠিক করলাম অন্য নম্বর থেকে অন্য নাম নিয়ে ওর সাথে না হয় একটু কথাই বললাম। তখন মেসো আমাকে অনন্ত সোমের সিমটা আমায় দিয়ে বলে এটা এখনো এক্টিভ আছে এটা দিয়ে কথি বল। তারপর স্যার আমি কোন আবেগে ভেসে গেলাম জানিনা। ” বলে কেঁদে ফেললো সুজাতা “আমি বুঝতে পারছালাম যে আমি আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছি অনিরুদ্ধর সঙ্গে, ও বার বার দেখা করার কথা বললেই আমার মন চন্চল হয়ে উঠত , কিন্তু আপনি বলুন স্যার এই মুখ নিয়ে যদি আমি ওর সামনে আসতাম তাহলে ওকে আমি চিরোতরে হারাতাম, তাই ভাবলাম রমাকে সরিয়ে দিই, কিন্তু ও নাছোড়বান্দা অনেকটা আমার মতন, তাই রমাকে অদৃশ্য করতে একটু ভৌতিক নাটক করতে হযেছিল , স্যার আমার মাসী মেসো আমাকে খুশি দেখতে চেয়েছিল , কারন আমি প্রায় দু বছর পর একটু মন খুলে হেসেছিলাম, এর পর আপনার যা মনে হয় করুন স্যার” পালবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের কোনটা মুছে নিয়ে ডাইরীর পাতাটা ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে বললেন “চলুন চলুন যে যার বাড়ি যান , কাল আমার মরনিং ডিউটি আছে ” অনিরুদ্ধ সুজাতার পায়ের কাছে বসে হাত দুটো ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে “ পারোনা আমায় ক্ষমা করতে ” সুজাতা দু হাত দিয়ে অনিরুদ্ধর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো “ ভালো থেকো । ”
পরদিন সকালে পালবাবুর ফোনে ঘুম
ভাঙলো অনিরুদ্ধর। ভোর ৪টে নাগাত সুজাতা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।