Saturday 1 August 2015

কালো মানিক

সারা দিনের ক্লান্তি যেনো খুব বেশি করেই ভর করে  যখন চার তলার সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হয়! অনেক বার ভেবেছে,বাসাটা চেঞ্জ করে দোতালা কিংবা একতলাতে নিবে,কিন্তু নেয়া হয়নি আর...আজকাল ভালো বাসা খুঁজে পাওয়া অনেক কষ্টকর,তার উপর বাসা চেঞ্জ করাতো আরো কষ্টকর! প্রতিদিনের মতো আজো এসব ভাবতে ভাবতে ফ্ল্যাটে ফেরে নবনী।

ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে যেয়ে নবনীর মনে হয়,'ইশ এই মুহুর্তে ঘুমের চেয়ে শান্তির কিছু আর কি হতে পারে?''কথাটা ভেবেই আপন মনে হাসল! কতো কাজ বাকী এখনো,রান্না বসাতে হবে,রুম পরিস্কার করতে হবে,নেক্সট উইকে অফিসে একটা প্রেজেন্টেশন আছে,রাতে সেটার ডাটা কালেক্ট করতে হবে নেট থেকে...ওমন অবসর এখন আর কোথায়? যে বাসায় ফিরেই শান্তির ঘুম দিবে!

সাড়ে আটটার দিকে মিঠু বাসায় ফিরে,ততক্ষনে নবনীর সব কাজ শেষ করে এশার নামাজ পড়ে ফেলে। তারপর একসাথে খেতে বসে। আজ মিঠু খেতে বসে বলল,

--আম্মা ফোন করেছিল,পরশু আসবে বিকেলের বাসে,শুক্রবার মেঝ মামার মেয়ের বিয়ে।

--ও,আচ্ছা। তোমার মেঝ মামার বাসা কোথায়?

--কুড়িল,খুব একটা আমার যাওয়া হয়না অবশ্য...

--আম্মা কি বিয়ে এটেন্ড করেই চলে যাবেন?নাকি আরো কয়েকদিন থাকবেন?

--কি জানি!বলেনি কিছু...

নবনী আশা করেছিল,মিঠু হয়তো বলবে যে,আম্মা ওকেও নিয়ে যাবে বিয়েতে এটেন্ড করার জন্য,কিন্তু মিঠু তেমন কিছুই বলল না! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ টেবিল গুছাতে লাগল নবনী। সব কাজ শেষ করে দু'মগ কফি নিয়ে রুমে এসে দেখল,মিঠু ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে,নবনীর একবার বলতে ইচ্ছে করল,

''সারাদিন পর বাসায় এসে খেয়েই কি ল্যাপটপ নিয়ে বসতে হবে?অন্তত ১০টা মিনিট সময় তো আমাকে দিতে পারো তাই না?'' কিন্তু কিছু বলল না,গত আট মাসে এমন কথা অনেকবারই সে বলেছে,কিন্তু ফলাফল কিছুই না! প্রথম দিকে কয়েকবার বললে পরে,ল্যাপটপ অফ করে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে স্যরি বলত,কিন্তু এখন আর কিছু করেনা,চুপ করে থাকে,কয়েকবার বললে,বিরক্ত হয়ে বলবে,

--তোমার কি মনে হয়,আমি ল্যাপটপে গেম খেলছি?জরুরী কাজ করছি,আর আমার কান খোলাই আছে,কি বলবে বল আমি শুনতে পাচ্ছি!''

কিন্তু নবনী বলতে চেয়েও আর বলতে পারে না যে,

-সারা দিন পর তোমার সাথে একটু কথা সময় চেয়েছি,ঝগড়া করার কিংবা তোমার বিরক্তি ভরা ঝাড়ি শুনতে চাইনি!

প্রতিদিনের মতো  তাই আজো,কিছু না বলে কফির মগটা মিঠুর সামনে রেখে বারান্দায় যেয়ে বসল। আজ পরিস্কার আকাশে আধখানা চাঁদ দেখতে পাচ্ছে,তারার আনাগোনা অনেক কম। আপন মনে গুন গুন করতে করতে জানালা দিয়ে রুমে থাকা মিঠুর দিকে তাকালো,একমনে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে,দিন দিন কতো বদলে যাচ্ছে মানুষটা! নবনীর মনটা ভারী হয়ে উঠলো,এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল?

এক বছর ও তো হয়নি ওদের বিয়ের,আর এখনই দুজনের মাঝে এতো দূরত্ব!

কতো স্বপ্নই না ছিল  নিজের সংসার নিয়ে,স্বামীকে নিয়ে,কিন্তু আজ সব কিছুই অনেক ফিঁকে হয়ে এসেছে...!আজ নবনীর কাছে মিঠু যতোটা গুরুত্বপূর্ণ নবনীর মনে হয় না,মিঠু তাকে অতোটা গুরুত্বপূর্ন ভাবে! নবনীর মনে পড়েনা,গত চার/পাঁচ মাসে মিঠু শেষ কবে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে ওর হাত ধরেছিল!কবে ফোন করে বলেছিল,'বউ শোন,আজ অফিস শেষে বাসায় যেতে হবে না,আজকে আমার তরফ থেকে তোমাকে ট্রিট দিবো!'... নবনীর চাকরী করার প্রবল ইচ্ছে কখনোই ছিল না,কিন্তু বিয়ের পর সংসারের প্রয়োজন আর ভবিষতের দিকে তাকিয়ে পড়া শুনা শেষ করেই চাকরীতে ঢুকেছে। মিঠু যা ইনকাম করে তার ১/৪অংশই বাড়িতে বাবা-মাকে পাঠাতে হয়,এই অবস্থায় নিজেদের সংসার চালানোর জন্য নবনীর চাকরী অপরিহার্য। কিন্তু তাই বলে ব্যাস্ততার অজুহাতে মিঠু দিন দিন এভাবে দূরে সরে যাবে,বদলে যাবে তা নবনী মেনে নিতে পারে না,তাই মাঝে মাঝেই ভাবে চাকরী ছেড়ে দিবে! কিন্তু ছাড়া হয় না।

''কি ব্যাপার?কোথায় হারিয়ে গেছো?সেই কখন থেকে মোবাইল বাজছে...'' মিঠুর হাঁক শুনে ধ্যান ভাঙ্গে নবনীর। রুমে এসে দেখে বড়'পা ফোন করেছে,রিসিভ করে কুশল বিনিময় করে বড়'পা বলল,

--তুইতো বিয়ের পর একেবারেই হাওয়া হয়ে গেছিস!শুক্রবার কি করছিস?মিঠু কে নিয়ে বাসায় চলে আয়

--না,আপা,পরশু আমার শ্বাশুড়ি আসবে,তার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে শুক্রবার।

--ওহ,তোরা সবাই ওখানেই যাচ্ছিস?তা কখন বিয়ে?

--এক মিনিট ধরো,জিজ্ঞেস করে নেই

মোবাইলটা হাতে রেখে নবনী মিঠুকে জিজ্ঞেস করলো,

--এই,শুক্রবার বিয়ে কখন?

--রাতে

--আমরা কখন যাচ্ছি?

মিঠু কিছুটা বিরক্তি  নিয়ে তাকিয়ে বলল,

--আমরা যাচ্ছি না,আমি সন্ধ্যায় আম্মাকে দিয়ে চলে আসব,পরের দিন অফিস শেষে নিয়ে আসব,তুমি চাইলে আপার বাসা থেকে ঘুরে আসতে পারো ওকে?

নবনী কিছুক্ষন চুপ  করে থেকে বড়'পা কে বলল,

--আপা,এই সপ্তাহে আসতে পারবো না,আরেকদিন দেখি,ওকে?

--আচ্ছা,ঠিক আছে,পরে ফোন দিস ওকে,আল্লাহ হাফেজ।

নবনী মোবাইলটা রেখে আয়নার সামনে দাড়ালো,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল...'খুব কি খারাপ দেখতে আমি??!গায়ের রঙ কালো তাই বলে কি মিঠুর পাশে আমি অনেক বেশি  বেমানান??!' নবনীর বড় বড় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠে... আর যতো যোগ্যতাই থাকুক না কেন,মেয়েদের বাহ্যিক সৌন্দর্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু,এটা বিয়ের পর অনেক ভালোভাবেই বুঝতে পারছে নবনী। নবনীর বিয়েটা কিভাবে কিভাবে যে হয়েছিল তা আজো বুঝতে পারে না!,অনেকটা হুট করেই হয়েছিল,ছোট খালুর অফিসের জনিয়র কলিগ ছিল মিঠু,ভালো,শিক্ষিতা,সংসারী মেয়ের কথা খালুকে বলেছিল,খালু নবনীর সিভি দেখালো,মিঠুর পছন্দ হলো! ব্যাস...এক মাসের মধ্যেই সব হলো। মিঠুর মা,ভাবী,বোনেরা ওকে দেখতে এসে বেশ শক খেয়েছিল,সেটা নবনী আর ওর পরিবারের সবাই বেশ ভালো ভাবেই বুঝেছিল,কিন্তু ছেলে ভালো এই কথা ভেবে কেউ তেমন উচ্চবাচ্চ করেনি অপর দিকে মিঠুর পরিবার ও মিঠুর যুক্তি আর পছন্দের কাছে হার মেনে হাসি মুখেই আংটি পড়িয়েছিলেন... কিন্তু বিয়ের একমাস পর যখন ঈদ করতে শ্বশুড় বাড়ি গেল,তখনই নবনী টের পেয়েছিল এ বাড়ির সবাই সুন্দরী বউ আশা করেছিল! সব কিছু দেখেও নবনী না দেখার ভান করে হাসি মুখে সবার মন জয় করার আপ্রান চেষ্টা করেছে এই আট মাস। খুব যে অসফল হয়েছে তা বলা যাবে না,অন্তত এতুটুকু শুনতে পেরেছে,

'হুম,মিঠুর বউটা দেখতে সুন্দর না হলে কি হবে,ব্যাবহার-কাজে মাশা'আল্লাহ অনেক ভালো,তারপরেও এতো কালো বউ আনার কি দরকার ছিল?দেশে কি সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল?!!''

নবনীর ও তাই মনে  হয়,আসলেই তো!কি দরকার ছিল মিঠুর ওকে বিয়ে করার?দেশে কি আর মেয়ে ছিল না?নাকি মিঠু এটা ভেবেছিল,কালো মেয়ে বিয়ে করলে অনেক সুবিধা আছে,এরা সংসারী হয়,অনেক স্যাক্রিফাইস করতে পারে!এ জন্য?!নবনী জানে কেন ওকে নিয়ে মামা শ্বশুড়ের বাড়ি মিঠু যাবে না,কারন জানে ওকে দেখে মামী-মামাতো ভাই-বোনেরা অনেক কথা শোনাবে! নবনী ভেবেছিল,আস্তে আস্তে এসবের সাথে ও অভ্যস্ত হয়ে যাবে,

কিন্তু পারে না,নিজের ব্যাক্তিত্বে অনেক লাগে,ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে চায়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে!!একি  ১১টা বেজে গেছে!

রুমে এসে দেখে মিঠু ল্যাপটপ এক পাশে রেখে প্রতিদিনের মতো এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে,নবনী সব কিছু ঠিক করে রেখে মশাড়ি টাঙ্গিয়ে লাইট অফ করে দিল। তারপর আবারো বারান্দায় যেয়ে দাড়ালো। নবনী জানে না,জীবনের এই অবস্থা থেকে ও কোনদিন মুক্তি পাবে কি না!আজ চাচাতো বোন নিপা'পু কে খুব হিংসে হয়!সে ও নবনীর মতোই কালো দেখতে,দাদী তাকে কালো মানিক বলে ডাকতেন।আর তার বর রফিক ভাই... সত্যিকারের জুহুরী বলা যায়!আর তাই পেরেছেন,নিপা'পুর মতো কালো মানিকের যথার্থ কদর করতে। মিঠু কি ওমন হতে পারতো না?... আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নবনীর বুক চিরে...

রাত গভীর হয়...কিন্তু বনস্রীর সি ব্লকের ২৫নম্বর  বাড়িটার চারতলার বারান্দার  গ্রিল ধরে একটা মেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদে চলে... প্রায়ই...