Thursday 7 May 2015

অসামাজিক

চুপ করে আর কতক্ষন বসে থাকবে বুঝতে পারছে  না নিলু!প্রায় ১ঘন্টা হয়ে  আসল।এতক্ষন কি চুপ করে থাকা যায়?!!এতক্ষন কথা না বলে থাকাটা খুবই কষ্টকর। দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয়!উফফ...!

পানি খাওয়া শেষ  করে গ্লাসটা রাখার জন্য ডায়েনিং এ এসে যাওয়ার সময় একবার ড্রয়িং রুমের  দিকে চোখ ফেরালো।সাঈদ এক মনে সোফায় বসে বই পড়ছে।

রাগে জ্বলতে লাগল নিলু,আশ্চর্য মানুষ!একটা মানুষ তার সাথে রাগ করে সকালের নাস্তা না করে কথা বন্ধ করে বসে আছে,অথচ তার কোন বিকার নাই!মনে হচ্ছে যেন এই বাসায় সে ছাড়া আর কেউ থাকে না,অদ্ভুদ!!এই রকম মানুষের সাথে কিভাবে সারা জীবন পাড় করবে নিলু সেটাই ভেবে কূল পেল না...!সরি বলা তো দূরের কথা,জনাবের চোখ ও এদিকে পড়ে না...!

নাহ, অনেক বেলা হচ্ছে,এইভাবে আর বসে থাকা যায় না। কাজ শুরু করতে যেয়ে একটু থমকে দাড়ালো আবার,দুপুরে রান্না কি করবে নাকি করবে না?!সাঈদের ভাবে তো মনে হচ্ছে না সে তার সিদ্ধান্ত বদলেছে...আবারো মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল নিলুর।অসামাজিক একটা মানুষ!আর কাউকে পায় নাই তার কপালেই এসে জুটেছিল!

সব দোষ বড় ফুপার! সোনার টুকরো ছেলে,কতো শত গুণ বলে ধাম করে বিয়েটা করিয়ে দিল।এখন বোঝা যাচ্ছে কত ধানে কত চাল! ধুর...!

রাগের চোটে ঘর ঝাড়ু দেবার জন্য ঝাড়ুটা হাতে নিয়েও ছুড়ে ফেলে দিল,কিন্তু নিশানা না থাকলেও ঝাড়ুটা যেয়ে পড়ল বেশ দূরে ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে।আওয়াজ শুনে মাথা তুলল সাঈদ,কিসের শব্দ হলো?!

বসা থেকে উঠে এসে  দরজার সামনে ঝাড়ু দেখতে  পেল,মুখে হাসি ফুটে উঠল সাঈদের,মাথা ঘুরিয়ে তাকালো বেড রুমের দিকে,বেড রুম থেকে এই খানের দূরত্ব বেশ ভালোই,সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে নিলু বেশ ভালো রাগ করেই ঝাড়ুটা ছুড়েছে! আহারে,কত রাগ বেচারীর!ভাবতেই আরো হাসি পেল সাঈদের।কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখল।এই মূহুর্তে হাসি মানে আরেক দফা ঝড়...

সাঈদকে দরজার সামনে  দাঁড়ানো দেখে নিলু বেড  রুমের দরজার সামনে এসে  দাড়ালো,ব্যাপার কি?সাঈদ কি হাসছিল...?!তার হাসি পাচ্ছে না?!!হুহ।

---তুমি কি সিদ্ধান্ত বদলেছ?নাকি আগের সিদ্ধান্তেই আছো?

কথাটা বলেই অন্য দিকে তাকালো নিলু।

--আমি তো বলেছি এসব দাওয়াতে যেতে আমার ভালো লাগে না।

--এসব দাওয়াত মানে কি?আমার কাজিনের ছেলের আকিকা অনুষ্ঠান,এখানে এসব দাওয়াতা শব্দটা কেন আসল?!সব আত্নীয় স্বজন আসতেছে,আমার কি সেখানে যাওয়া উচিত না?

--তো যাও,আমি তো মানা করছিনা।

--আমি একা যাবো?

-আবারো শুরু করলে,সকালে তো বললাম একবার,আমার যেতে ইচ্ছে করছে না,তুমি যাও।

--সাঈদ,অদ্ভুদ কথা কেন বল তুমি?তোমার আমার বিয়ে হয়েছে এক বছর ও হয়নি এরই মধ্যে তুমি বোর হতে শুরু করে দিলে?আমি একা যাব?সবাই যখন জানতে চাইবে তখন কি বলব?তোমাদের জামাই বাসায় ঘুমাচ্ছে আর আমি আসছি বেড়াতে?!কি ভাববে সবাই?...

সাঈদ কিছু না বলে  আবারো সোফায় এসে বসল,একটু চুপ থেকে বলল,

--দেখ,আমি সব সময় এইসব দাওয়াত,ভীড়-ভাট্টা থেকে দূরে থেকেছি,এমনকি আমার ফ্যামিলি প্রোগ্রামেও আমি অনেক কম গিয়েছি,কারণ আমার ভালো লাগেনা তাই।তোমাদের বাসার কম অনুষ্ঠানে তো আর এটেন্ড করিনি,সবাই অলরেডি আমাকে চিনেছে,সো প্লিজ,আমাকে আর জোর করো না।

--তাহলে দুপুরে তুমি কোথায় খাবে?

--কোথায় আর বাসায়ই খাবো,আমার জন্য ভাত রান্না করে যাও আমি ডিম ভেজে খেয়ে নিব।''

সাঈদের কথা শুনে এবার রাগ ছেড়ে কান্না চলে  আসল নিলুর।মানুষটা এমন  কেন?! কোথাও যেতে বললেই একশটা বাহানা দাড় করাবে,অন্তত নিলুর মনে অবস্থাটা তো বুঝবে তাও না...যাবে না ব্যাস যাবেই না।রুমে বসে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে নিলু।আজকে মুক্তা আপুর বাসার অনুষ্ঠানে ওর তিনজন স্কু্ল ফ্রেন্ড ও আসবে তাদের বর নিয়ে,কতো দিন পর ওদের সাথে দেখা হবে,কতো প্ল্যান করে রেখেছিল আর সেখানে সাঈদ সব একেবারে পন্ড করে দিল।ছুটির দিনে স্বামীকে বাসায় রেখে বঊ যাবে দাওয়াত খেতে,আর সে বাসায় বসে ভাত খাবে ডিম ভাজি দিয়ে!মানুষ শুনলে কি বলবে?!!

কিছুক্ষন পর চোখ মুছে রান্না ঘরে যেয়ে দুপুরের খাবার রেডি করতে লাগল নিলু।ইচ্ছে করেই মোবাইলটা বেড রুমে রেখে গেল,এরই মধ্যে ছোট বোন ফোন দিল,ভাবী ফোন দিল রাগ করে কারো ফোনই ধরল না।ও জানে ফোন ধরলেই সবাই জানতে চাইবে আজকে প্রোগ্রামে কখন আসছে,কি পড়বে এসব কথা। কিন্তু যেহেতু সে যাচ্ছে না সো,তার থেকে ফোন না ধরাই ভালো।

সাঈদ জুমার নামাজে যাওয়ার জন্য রেডী হতে রুমে এসে বুঝলো নিলু দাওয়াতে  যাচ্ছে না।সে মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচল! হঠাত নিলুর মোবাইলে ম্যাসেজ টোণ বেজে উঠল,সাঈদ অন করে দেখল নিলুর ছোট বোন ম্যাসেজ দিয়েছে,''কিরে আপু,ফোন ধরিস না কেন?কখন আসতেছিস তোরা?''।সাঈদ বুঝল নিলু ইচ্ছে করেই কারো ফোন ধরছে না।

এবার সাঈদের নিজেরই মনটা কেমন জানি খারাপ হয়ে  গেল!নাহ,কাজটা ঠিক হচ্ছে না।নিলু ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছে শুধু শুধু।কিন্তু সাঈদ ই বা কি করবে?ওর মানুষের এত ভীড় ভালো লাগেনা।সব সময় ই সে একটু ঘর কুনো টাইপের ছেলে ছিল,এ নিয়ে ফ্যামিলিতে কম কথা শুনতে হয়নি,কিন্তু সবাই বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিল,তাই আর কিছু বলতো না।পরে দেখা যেতো ও কোথাও না গেলেই বরং সবাই খুশী হতো,বাসা পাহারা দেয়ার কেউ থাকলো এই ভেবে!সাঈদ ভেবেছিল নিলুও আস্তে আস্তে ওর অভ্যাসের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

কিন্তু নাহ,উল্টো আরো ওর জন্য সে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে...!

রান্না ঘরে ঊকি  দল সাঈদ,নিলু কাজ করছে আর চোখ মুছছে।হায়রে!চোখের পানি ঝড়তে একটু ও সময় লাগেনা!এদিকে রান্নাও তো বসিয়ে দিয়েছে এখন যদি যাওয়ার কথা বলে তাহলে খবর আরো খারাপ হবে...কি উভয় সংকট!!



নিলু অবাক হচ্ছে  খুব!ব্যাপার কি?!নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে অথচ সাঈদের বের হবার লক্ষণ নেই! সময়ের দিকে খেয়াল নেই নাকি আজ?!!হায়,আল্লাহ নিশ্চয়ই বই পড়তেছে বসে বসে।দ্রুত রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে উকি দিল,নাহ নেই।

বেড রুমে গেল,দেখে,সাঈদ খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবছে!

আনমনে একটা ভেংচি  কাটল নিলু,হুহ,ভাব কি দেখোনা!

সাঈদ নিলুর দিকে তাকিয়ে একটা কার্টুন মার্কা হাসি দিয়ে বলল,

--আজ দুপুরে কি রান্না হচ্ছে ম্যাম?

--ঘোড়াড্ডিম রান্না হচ্ছে।

সাঈদ একটা গোবেচারা ভাব নিয়ে বলল,

--ওও...আসলে আমার না আজকে ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে,এই যেমন বিরিয়ানী সাথে কাবাব,বোরহানী টাইপ কিছু।!

নিলু ভ্রু কূঁচকে বলল,

--ঢং করার চেষ্টা করবা না,আপু দাওয়াত দিল,যাবা না এখন আবার ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করে না?

--আপুর বাসায় কি এসব রান্না হচ্ছে?

--নাহ,তোমার মাথা আর আমার মুন্ডু রান্না হচ্ছে,আকিকার অনুষ্ঠানে কি রান্না হয় তা আপনি জানেন না?

--আরে আগে বলবা না এই কথা?তাহলে চল যাই,শুধু খাওয়া মিস করে লাভ কি বল,এই উসিলায় তোমারও বেড়ানো হলো আমার ও খাওয়া হলো...!!

নিলু হা করে তাকিয়ে থাকে!!এই লোক বলে কি?!!

নিলুর তাকিয়ে থাকা দেখে সাঈদ বলে,''আরে ভাই,হাআ করে তাকায়ে না থেকে জলদি রেডি হও,আমি যেন নামাজ পড়ে এসে দেখি আপনি রেডি আছেন,আপনার তো আবার ব্যাপক সময় লাগে,যদি দেরী হয় আমি একাই চলে যাব...ওকে?হাহাহাহা!''

সাঈদ হাসতে হাসতে  বাথরুমে ঢুকলো আর নিলু একই ভঙ্গীতে বিছানায়  বসে রইল।


লিখেছেন - শুকনোপাতা