Wednesday 11 March 2015

প্রথম পুরস্কার

জীবনে সেই যা আমার পুরস্ককার লাভ – সেই প্রথম আর সেই শেষ। কিন্তু এ রকমটা যেন তোমাদের কারও কখনও না ঘটে।
ক্লাস টেন এ প্রমোশন পেয়েই মামাকে গিয়ে জানালাম।
টেন এ উঠেছিল! বলিস কিরে! মামা তো হতবাক। টেনে উঠলি? বাঃ!
এখনই বাঃ কি মামা? আসছে বছরে এনট্রান্স পরীক্ষা দেব, তা জানো?
বলিস কিরে! আমাদের বংশে কেউ যে কখনো এনট্রান্সের চৌকাঠ মাড়ায়নি। সাত জন্মে না। সাত পুরুষে নয়।
সাত পুরুষের খবর রাখি না, তবে তিন পুরুষের জানি। আমার মামা বাংলা পাঠশালায় পড়ুয়া, ছাত্রবৃত্ত পাশ। তারপর তিনি আর এগোন নি। নিজের ব্যবসা নিয়েই রয়েছে।
আর মামার দাদামশাই ছিলেন ছিলেন টোলের পন্ডিত। ইংরাজির ধার ধরতেন না। সংস্কৃত নিয়ে থাকতেন, টোল ছিল তাঁর। তাঁর ধাক্কায় টোলে পড়তে পড়তে খুব আমি টাল সামলে নিয়েছিলাম।
আর তাঁর বাবার আমলে এনট্রান্সের পাটই ছিল না। তিনি জানতেন শুধু ফার্সি। মৌলভিদের মক্তবে পড়েছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার লেখা কী একটা ফার্সি চিঠি পড়ে দিয়ে কোন এক সাহেবের কাছ থেকে একটা সোনার ঘড়ি নাকি বখসিস পেয়েছিলেন তিনি।
সেই সনাতন বংশে প্রথম ‘এ-বি-সি-ডি’ নিয়ে এলাম আমি। কেবল নিয়ে আসা নয়, এনট্রাস পাশ করে সেই ‘এ-বি-সি-ডি’-র ছেরাদ্দ করে ছাড়ব। বি এল এ ব্লে থেকে শুরু করে এতদূর যখন টেনে হিঁচড়ে নিজেকে আনতে পেরেছি, তখন বাকিটুকুও কোনরকমে ঠেলে ঠুলে উৎরে যেতে পারব আশা করি।
মেজোমামার আনন্দ ধরে না- কী পুরস্কার চাস বল?
কী দেবে দাও – আমিতো লাফিয়ে উঠি।
এই সোনার ঘড়িটা নে – বলে মামা জেব থেকে চেন লাগানো ঘড়িটা বার করলেন – দেখেছিস? মোকবের – সোনার ঘড়ি। পাঁচশো টাকা দাম। আমার ঠাকুরদাকে দিয়েছিল এক সাহেব। বেঞ্জামিন সাহেব। ভেবে ছিলাম তুই এনট্রান্স এগজামিন পাশ করার পর বেঞ্জামিনের ঘড়িটা তোকে দেব। তার আগেই নে তুই। ক্লাস টেন এ তো উঠেছিস। যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপান্ন।
ঘড়ি নিয়ে কী করব মামা? ধুয়ে ধুয়ে খাব? - আমি বললাম - ঘড়ি তোমার থাক।
তাহলে কী চাস তুই?
টাকা দাও বরং আমায়। ওই ঘড়ির দামের টাকার দিয়ে দাও।
পাঁচশো টাকা! পাঁচশো টাকা নিয়ে কি করবি রে তুই?
খাবো।
খাবো! পাঁচশো টাকার কী খাবি? এমন কী খাবার আছে?
কেন রসগোল্লা, সন্দেশ, জিবে গজা, জিলিপি, চানাচুর, চকোলেট, চীনেবাদাম......
পাঁচশ টাকার চিনে বাদাম। তা খেলে আর বাঁচতে হয় না। আর যদি বাঁচিসও, তোর চেহারা চীনেদের মতন হয়ে যাবে। কিম্বা একটা বাদাম হয়েও দাড়াতে পারিস।
তাহলে রেখে দেব।
রাখবি কোথায়? তোর কি বাসকো পেঁটরা আছে? টাকা রাখতে হয় সিন্দুকে?
কেন আমার পকেটে রাখবো। সিন্দুকে আমি বিন্দু জ্ঞান করি। বিন্দুমাত্র আমল দিই না- থাকবে আমার এই বুক পকেটে।
পকেটে। পকেটে টাকা কড়ি নিয়ে গুরে বেড়াবি যেখানে সেখান?
বেড়াবই তো। দেখিয়ে বেড়াবো সবাইকে। বা রে, বন্ধুদের কে দেখাতে হবে না?
তা না হলে আবার কিসের টাকা।
তবেই হয়েছে। চারিদিকে যা পিকপকেট হয়! কোলকাতায় কোথাও কি আর পা বাড়াবার যো আছেরে কোথাও! পকেটমারই টাকাটা মের দেবে তোর।
তা আর মারতে হবে না। আমার পকেটে হাত দেবে এমন মানুষ এখনো জন্মায়নি মামা। চারধারই তো ঠক জোচ্চর। ঠক বাছতে গাঁ উজাড় এই কলকাতায়।
দিয়ে দ্যাখো না আমায়?
নে তাহলে। আয়রন সেভ খুলে পাঁচখানা একশো টাকার নোট আমার হাতে তুলে দেন – দেখিস যেন বেহাত না হয় কখনও।
আমার টাকা আর হাত সাফাই করতে হবে না কারোকে। এতো বড় ম্যাগেসিয়ান এদেশে নেই।
টাকাটা পকেটে নিয়ে ঘুরবি বলছিস। বাড়ি ফিরে রোজ রোজ দেখাবি আমায় কিন্তু। পাঁচখানা নোট গুনে গুনে দেখবো আমি।
দেখাবো দেখাবো – বলে আমি বেড়িয়ে পড়লাম – বন্ধুদের দেখাবার জন্য।  তাদের কারো পাঁচটাকার বেশি মুরোদ নেই, পাঁচশো টাকায় কেমন তাদের তাকলেগে যায় দেখতে হবে।
পাড়ার হুদ্দা পার হয়ে একটা পার্কের পাশদিয়ে যাচ্ছি এমন সময় এক ভদ্রলোক ডাকলেন।
খোকা তোমার আদ্দির পাঞ্জাবির ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে সব।
অ্যাঁ? চমকে গিয়ে থমকে দাড়াই।
নোটগুলো সব দেখা যাচ্ছে যে। - আমার ঘড়ে হাতরেখে তিনি বললেন – অমন করে টাকা রাখতে নেই ভাই, পকেটমারের নজরে পড়লে আর রক্ষে নেই। ম্যানিবেগের মধ্যে রাখবে টাকা।
ঘাড়কে হস্তচ্যূত করে হটে যাই – কিনবো ব্যাগ।জানিয়ে দিই সংক্ষেপে।
নোটের নম্বর গুলো তোমার টোকা আছেতো সব।– তিনি শুধালেন।
নোটের নম্বর? – অবাক হতে হয়।
হ্যাঁ, নোটের কোনার দিকে নম্বর থাকে, বড় বড় নোটের নম্বর টুকে রাখতে হয় আলাদা কাগজে। ধরো, বলা যায় না, টাকাতা তোমার খোয়া গেল। তখন তুমি থানায় গিয়ে পুলিসকে জানাতে পারবে নোটার নম্বর দিয়ে। পুলিস তখন খবরটা জানিয়ে দেবে সবাইকে। কেউ ওই নম্বরের নোট বাজারে চালাতে গেলে ধরা পড়ে যাবে হাতে হাতে। টাকাটা তোমার উদ্ধার হবে তখন।
লোকটা ভালো কথা বলেছে বলে আমার মনে হল। কিন্তু আমার কাছে এখন কাগজ কলম কিছুই নেই তো!
এই নাও কাগজ দিচ্ছি, বলে তিনি তার ডায়রি  বইয়ের থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে দিলেন।
 - এই নাও আমার কলম। নোটগুলো আমার হাতে দাও আমি নম্বর বলে বলে যাই আর তুমি টুকে নাও।
বললেই টাকাগুলো ওর হাতে অমনি তুলে দিলাম কিনা। তেমন বোকা আমি নই। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে আমি তাকাই। তেমন যেন সুবিধার নয় লোকটা।
আচ্ছা আচ্ছা। তুমি নম্বরগুলো বলো, আমি তোমায় টুকে দিচ্ছি না হয়।
আমি বলে বলে গেলাম, নম্বরগুলো তিনি টুকে নিলেন।
এইবার আমার মানিব্যগটা তুমি রাখ। ব্যগের মধ্যে টাকা কড়ি কিছু নেই, খালি ব্যাগ। ব্যাগটা আমি তোমায় উপহার দিলাম। এর ভেতরে তোমার নোটগুলো সাজিয়ে রাখ। তাহলে কারও চোখে পড়বে না।
আপনার ব্যাগ আমি নিতে যাব কেন?
আমি কি তাই বলেছি। আমার চেয়ে তোমার এখন বেশি টাকা। আমি কি তোমাকে একেবারে দিচ্ছি ব্যাগটা? জন্মের মতো নিতে বলছি কি? তোমার ব্যাগ কেনার পর আমাকে এটা ফিরিয়ে দিয়ো না হয়। ব্যাগের মধ্যে আমার নামের কার্ড রয়েছে। নরহরি সামন্ত, বৈঠকখানা রোড, এই ঠিকানায় তুমি দিয়ে এসো আমাকে।
তবু দোনামনা যায় না।
ওই দেখ, একটা পুলিসের লোক আসছে। ছেলেপিলেদের হাতে টাকা থাকা ওরা ভারী অপছন্দ করে, ভীষন সন্দেহর চোখে দেখে। ভাববে তুমি হয়তো বাড়ির ক্যাশ ভেঙে পালিয়েছ, পাকড়ে নিয়ে যাবে থানায়। নাও চট করে পুরে ফেলো টাকাটা।
পুলিশ দেখে ব্যগ্র হয়ে আমি টাকাগুলো ব্যাগস্থ করি।
তারপরেই কি যে ঘটে গেল।
আমার ব্যাগ, আমার মানিব্যাগ! কোথায় গেল আমার মানি ব্যাগ! লোকটা চেঁচীয়ে উঠলো হটাৎ। অনেক টাকাছিল যে আমার ব্যাগে।কে পকেট মারলো আমার।
পুলিস ইন্সপেক্টর থমকে দাঁড়ালেন আমার কাছে এসে – কি হয়েছে মশাই? কি হয়েছে?
আমার মানিব্যাগ পকেট থেকে কে তুলে নিয়েছে দেখুন। - আর্তনাদে ফেটে পড়ল লোকটা – পাঁচশো টাকা আমার তাতে। সব খোয়া গেল আমার।
ইন্সপেক্টর খপ করে হাত চাপে ধরলেন আমার – এই ব্যাগ কি আপনার, দেখুন তো?
হ্যাঁ এই তো সেই ব্যাগ। দেখুন দেখুন, ওর ভিতর আমার নোটগুলো সব আছে কিনা দেখুন, একশো টাকার পাঁচখানা নোট – এই এই নম্বর – পকেট থেকে কাগজখানা বার করে নম্বরগুলো তিনি আউড়ে গেলেন – আমার নামের কার্ডও রয়েছে ব্যাগের ভেতরে। নরহরি সামন্ত, বৈঠকখানা রোড।
হ্যাঁ রয়েছে। সবই তো মিলে যাচ্ছে, এই নিন আপনার মানিব্যাগ। ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করছি। আপনি থানায় চলুন আমার সঙ্গে। আপনার অভিযোগ ডাইওরি করবেন।
আমার অভিযোগ। আমার কিসের অভিযোগ? পেয়ে তো গেলাম। তাছাড়া অভিযোগ করবার আমি কে? আমি কি বিচার করবার মালিক? মানুষ কি মানুষের বিচার করতে পারে? কেউ নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে সে কথা?
আপনি কি বলছেন মশাই? – ইন্সপেক্টর যে অবাক।
ঠিকই বলছি, ছেলেরা সব দেবতুল্য। কেউই তাদের খারাপ হয়ে জন্মায় না। সঙ্গদোষে, শিক্ষার ত্রুটিতে খারাপ হয়ে যায়। এর জন্য দায়ী সমাজ, সংসার, কাকা, পিসে, মেসো, মামা। এই আমার অভিমত।
কিন্তু আইন মাফিক- বলতে যান ইন্সপেক্টার।
আমি যদি ছোঁড়াটাকে জেলের মুখে ঠেলে দিই,সেখানে ও ওস্তাদ বদমায়েসদের পাল্লায় পড়ে তাদের হাতে শিক্ষালাভ করে পাকা চোর হবে, চোর থেকে ডাকাত হবে, ডাকাত থেকে খুনি হবে, তারপর খুনি থেকে...
ফাঁসি হবে। তাছাড়া কিছুই হবে না।
আমি ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে যেতে চাই না। আপনি দয়া করে ওকে ছেড়ে দিন। - বলে তিনি আমায় মার্জনা করে চলে যান।
আমি ইন্সপেক্টরের মার্জনাও লাভ করি।
এখন মামা মার্জনা করলে হয় আমার।
লেখক – শিবরাম চক্রবর্তী
অনুলিখন- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী