Tuesday 17 February 2015

শ্যামডাঙার মাঠ

বর্ধমান সদরঘাটে দামোদর নদ পার হয়ে রায়নার দিকে যাতে হলে গোরুর গাড়িই তখন ভরসা ছিলো । এ হল ষাট সত্তর বছর আগের কথা। একশো বছর আগে যে এখানকার পরিস্থিতি কি ছিল তা ভাবাই যায় না। রায়নার কাছে নাড়ুগ্রামে আমাদের পৈতৃক নিবাস । ছোটোবালায় সেখানেই এক প্রবীনের মুখে গল্পটা শুনেছিলাম। এই সমস্ত অঞ্চল ছিলো ঘন বনে জঙ্গলে ভরা । আর ছিল ভয়ঙ্কর সব ডাকাত ও ঠাঙাড়ের উপদ্রব । দিন মানেও তখন এইসব অঞ্চলে পথ চলা ছিল ভয়ের ব্যপার।
রায়না থানার দারোগা তখন ঘনশ্যাম ত্রিবেদি। অত্যন্ত দুঁদে দারোগা বলে তখন তাঁর নামে বাঘে গরুতে জল খেত। তা কোন এক শীতের রাতে ঘনশ্যামবাবু তাঁর অফিস ঘরে বসে কেস ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছলেন, এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে তাঁকে সেলাম জানিয়ে ফিসফিস করে কী যান বলল।

শুনেই চমকে উঠলেন ঘনশ্যামবাবু । বললেন ‘ঠিক দেখেছিস?’ ‘হ্যাঁ সাব,শুধু আমি নয় আরও যারা দেখেছে তাদের মুখেও শুনলাম।’
‘কোথায় দেখলি তাকে?’
শ্যামা ডাঙার মাঠে। আমাকে দেখেই লুকিয়ে পড়ল। প্রায় দু’তিন ধরেই নাকি সন্ধ্যের পর দেখা যাচ্ছে ওকে ।
ঘনশ্যামবাবু অত্যন্ত সাহসী ও পরাক্রমশালী দারোগা। কনস্টেবলের মুখে এই কথা শুনে তিনিও বিচলিত হলেন। ফেরারি আসামি আবার ফিরে এসেছে শুনে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তার। ওর অসাধ্য যে কিছু নেই তা তিনি বেশ ভালোরকমেই জানেন । ধরা পড়ার আগে লোকটা এই অঞ্চলে কাঁপিয়ে বেড়াত। সবাই বলতো, মেধো গুন্ডার চেয়ে নৃশংস আর কেও নেই। চার পাঁচজনের একটি দল নিয়ে চুরি, ডাকাতি, খুন প্রভৃতি নানা অত্যাচার করে বেড়াত সে। লোকটা ছিল এমনিই ধূর্ত যে বহু চেষ্টা করেও তাকে কেউ ধরতে পারেনি।
তার সম্বন্ধে একটাই প্রবাদ ছিল যে, বাতাসেও সে বিপদের গন্ধ পায়। তা ঘনশ্যামবাবু অনেক চেষ্টার পর রীতিমতো ফাঁদ পেতে একদিন ধরে ফেললেন তাকে। শুধু কি ধরা ? বেদম পিটিয়ে সোজা পাঠিয়ে দিলেন বর্ধমান সদরে।
তখন তো ইংরেজ রাজত্ব। মেধো গুন্ডার বিচার হল, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দশ বছরের জেল হল তার । দন্ডাদেশ শুনে মেধো একটি কথায় বলেছিল, দশ বছর কেন দশ মাসও আমাকে ধরে রাখতে পারবে না কেউ। তারপর ঘনশ্যাম ত্রিবেদিকে আমি দেখিয়ে দেব মেধো গুন্ডা কত ভয়ঙ্কর।
সেই মেধো গুন্ডা তিন মাস জেল খাটার পরই এক রাতে জেল ভেঙ্গে সবার চোখে ধুলো দিয়ে উধাও হয়ে যায়। সেই থেকে ঘনশ্যামবাবুর দারুন আতঙ্কে ছিলেন । দেখতে দেখতে দু দুটো বছর কোথাদিয়ে কাটে গেল। তারপর হটাৎই তার এই আবির্ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠলেন ঘনশ্যামবাবু । মেধো যখন ফিরে এসেছে তখন একটা না একটা অঘটন ঘটাবেই। তাই কনস্টবলের মুখে ওর কথা শুনেই বললেন ‘তাহলে আর দেরি নয়, এখনই রওনা হওয়া যাক।’
কনস্টেবল বলল ‘ কিন্তু সাব, রাতে আমরা কেউ শ্যামডাঙার মাঠে পা রাখি না।’
‘কেন?’
‘ভূতের ভয়ে’
‘ভূতের ভয়। তাহলে মেধো গুন্ডা ওখানেই আত্মগোপন করে আছে কী করে ? ভূতেরা ওকেই গলা টিপে মারত।’
কনস্টেবলের ভয় দেখে ঘনশ্যামবাবু বললেন ‘ ঠিক আছে। কাউকে যেতে হবে না আমার সঙ্গে । আমি একাই যাব। তুই শুধু দূর থেকে জায়গাটা আমায় চিনিয়ে দিয়ে আসবি চল।আমি অন্ধকারে গা ঢাকা  দিয়েই মাঠে যাব।’
ঘনশ্যামবাবু রীতিমতো তৈরি হয়েই কনস্টেবলের সঙ্গে শ্যামডাঙার মাঠে দিকে এলেন। কনস্টেবল দূর থেকে জায়গাটা চিনিয়ে দিতেই ঘনশ্যামবাবু অন্ধকারে মিশে মাঠের একটি গাছ তলায় এসে ঘাপটি মেরে রইলেন। অনেক পরে মনে হল গাছের শুকনো ঝরা পাতা মাড়িয়ে খস খস শব্দ করে কে যেন আসছে । ঘনশ্যামবাবু দারুন সতর্ক হয়ে এক হাতে টর্চ ও অপর হাতে রিভলভার ধরে ওৎ পেতে রইলেন । একটু পরে চোখের সামনে এক ছায়ামূর্তি প্রকট হতেই ঘনশ্যামবাবু টর্চের আলো ফেললেন তার গায়ে। তার চোখের সামনে ভয়ংকর মেধো গুন্ডা প্রকট হয়ে উঠল। কিন্তু তা বারেকের তরে। গায়ে আলো পার হতেই সঙ্গে সঙ্গেই প্রানপনে ছোটা শুরু করল মেধো।
ঘনশ্যামবাবু চেঁছিয়ে বললেন, ‘হল্ট’।
মেধো গুন্ডা থামল না।
ঘনশ্যামবাবু হেঁকে বললেন, ‘এখনও বলছি থাম। নাহলে কিন্তু গুলি করব’।
মেধোর বয়েই গেছে থামতে। কেনই বা থামবে ? পুলিশের গুলি খাবার জন্য কেউ কোনদিন থামে নাকি ? অগত্যা নিরুপায় হয়েই ঘনশ্যামবাবু রিভলভার তাক করে গুলি করলেন মেধোকে । পরপর দুটো গুলি। কিন্তু তার একটাও তার গায়ে লাগল না।
ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল মেধো।
ক্লান্ত ঘনশ্যামবাবু তখন সু-বৃহৎ একটি বট গাছের নীচে এসে এসে বসলেন। একটা সিগারেট ধরানোর ইচ্ছা হল তাঁর । সিগারেট মুখে নিয়ে পকেট হাতড়ে দেশলাই বার করতে গিয়েই চমকে উঠলেন। দেখলেন একটি জলন্ত লাইটার এসে তাঁর সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে নিভে গেল। কে যে এই কাজ করল তা কিছুই বুঝতে পারলেন না । উনি টর্চের আলোয় চারিদিকে বেশ ভালোভাবে দেখে নিয়েই কেও কোথায় নেই। এতক্ষনে তার মনে একটা ভয় ঢুকল । তবে কি শ্যামডাঙার মাঠে ভয়ের ব্যাপার সত্যিই কি কিছু আছে? তবু তিনি মনকে শক্ত করে বসে রইলেন। এমন সময় হটাৎ তাঁর ঘাড়ে একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ল। ঘনশ্যামবাবু চমকে উঠলেন ‘কে’?
কোন উত্তর নেই, তবে হালকা একটা হাসির শব্দে তিনি শুনতে পেলেন। হটাৎ দূরে একটি ছায়া মূর্তি  স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঘনশ্যামবাবু তার গায়ে টর্চের আলো ফেলতেই অন্ধকারে মিশে গেল সে। সেই আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন মেধোকে । তবু অকারনেই আবারও একটা গুলি করলেন এবং সে গুলিও ফসকে গেল ।
এইভাবে সারারাত গুলি চালাতে চালাতে একসময় সব গুলিও শেষ হয়ে গেল। ঘনশ্যামবাবুও এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন মাঠের মাটিতে । অমনি সময় চারিদিক থেকে কখনোও হাহাকার, কখনও কান্না আবার কখনও হা হা করে হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। অমন ঘনশ্যামবাবু , তিনিও বুঝলেন এবার তিনি কাদের পাল্লায় পড়েছেন। তাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে জ্ঞান হারালেন সেখানেই।
বেশ কিছুক্ষন কেটে যাবার পর মনে হল, কে যেন তাঁর তার হাত ধরে টেনে তুলল।
ঘনশ্যামবাবু চোখ মেলে দেখলেন মেধো। কী ভয়ংকর তার মূর্তি।
মেধো বলল ‘ভয় পেলেন ঘনশ্যামবাবু? আমি সেই মেধো গুন্ডা। বলেছিলাম না দশ বছর কেন দশ মাসও আমাকে কেউ জেলে রাখলে পারবে না। তিন মাসের মাথায় আমি জেলভেঙ্গে পালিয়ে আসি। তারপর এদেশ সেদেশ ঘুরে এখানে এসে সাপের ছোবলে মরলাম। আপনাকে দেখাদেওয়ার ইচ্ছাছিল তাই মাঠের আসেপাশে ঘোরাঘোরি করতাম । আমি জানতাম , আমার দর্শন পেতে একদিন ঠিকই আসবেন। এলেনও তাই। যাই হোক মৃত্যুর পরে আর কোন প্রতিহিংসা মনের মধ্যে পুষে রাখা ঠিক না। এখন আসুন আপনি আমার সঙ্গে’।
ঘনশ্যামবাবু অতি কষ্টে বললেন – কোথায় যাব?
এই মাঠের শেষে যেখানে আমার দেহটা ফুলে পচে ঢোল হয়ে আছে সেখানে । গিয়ে দেখবেন কী মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে আমার।
ও দেখে আমি আর কি করব? আমার এখন অনেক কাজ।
আপনার এখন একটাই কাজ আমার সঙ্গে সব সময় ঘুরে বেড়ানো।আমরা দুজনে আরও অন্যান্যদের সঙ্গে মিশে এই শ্যামডাঙার মাঠেই বায়ুভক্ষ নিরাকার হয়ে রয়ে যাব। ওই দেখুন আপনার নিথর দেহটা কেমন মাটি আকঁড়ে শুয়ে আছে। কাল সকালে থানার লোকজন গ্রামের লোকজন আপনার খোঁজে এসে যদি উদ্ধার করে দেহটাকে তবেই আপনার সৎকার হবে। নাহলে আমারই মতো অবস্থা হবে আপনারও ।
ঘনশ্যামবাবু কি যেন বলতে গেলেন। কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। বাড়ির কথা মনে পড়ল। বউ ছেলে মেয়েদের মুখগুলো মনে পড়তেই হাহাকার করে উঠল বুকের ভিতরটা। নিজেদের মরদেহের দিকে একপলক তাকিয়েই মেধোর হাত ধরে মিশে গেলেন ঘন অন্ধকারে।  

অনুলিখন- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী