Saturday 14 February 2015

অস্থি বিসর্জন

ভগীরথপুরের হাবল চৌধরীর তখন অল্প বয়স। ব্যায়াম করা মজবুত শরীর । বড় বড় চোখ, টিকাল নাক আর পুরুষ্ঠ ঠোঁট। কুচ কুচে চুল উল্টিয়ে আচড়াত সে। ভয় কাকে বলে জানত না সে একটি সাইকেল ছিল তার, আর এই সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে ঘুরে বেড়াত গাঁয়ের পথে। শখের মধ্যে ছিল নানান রকমের পায়রা পোষা,রেডিও আর কলের গান ছিল তার সঙ্গী। তার গানের গলাটি ছিল ভারি মিষ্টি, সাইকেল চালাতে চালাতে গান গাইত সে। সে শুরের মূর্ছলায় তার ভাইপো ভাইঝিরা আর বৌদিরা মুগ্ধ হয়ে তারিফ করত তার। সব সময় পরিস্কার জামা কাপড় পরত সে। বিকেল বেলা হলেই তাকে দেখা যেত ধবধবে সাদা কোঁচানো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবী পরে ছাদে উঠে পায়রার খাঁচা খুলে দিয়ে পায়রা ওড়াত।
 আঃ আঃ আঃ শব্দ করে পায়রাদের ছাঁচা থেকে বের করে নীল আকাশে উড়িয়ে দিত সে। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা সুন্দর সুন্দর পায়রা ছিল তার। তাদের কারো পায়ে রূপোর মল তো কারো সোনার মল। এসবই শখ করে তার প্রিয় পায়রাদের জন্য তৈরি করেছিল সে।
জমিদারের ছেলে হয়েও বিষয় সম্পত্তি কাজকর্ম বিষয়ে সে ছিল উদাসীন। তার সহজ সরল ব্যবহারের জন্য গাঁয়ের লোকের কাছে সে ছিল অতি আপন জন। তাদের গায়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদী। তখন গ্রামের কোন গরীব ব্যাক্তির মৃত্যু হলে তার আত্মীয় পরিজন ভৈরবের তীরে বালুচরে মৃতদেহ সৎকার করত। তাদের ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ ছিল না বিশ মাইল দূরে বহরমপুরের গঙ্গাতীরের শ্বশানে নিয়ে গিয়ে মৃত দেহ সৎকার করার।
এই হাবল চৌধরী করত কি মৃত ব্যাক্তির অস্থি নিয়ে বিশ মাইল দূরে বহরমপুরে গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিয়ে আসত। বহু ব্যাক্তির যেমন থাকে মরা পোড়ানোর ঝোঁক, তেমনিই হাবল চৌধরির ছিল মৃতের অস্থি গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দেওয়ার ঝোঁক
তার এই বিশেষ ঝোঁকের কথা গ্রামের প্রত্যেকেই প্রায় জানত । গ্রামের অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধারাই তাকে অনুরোধ করত, ‘হ্যাঁ বাবা , হাবল আমি মরলে আমার অস্থিটিও গঙ্গায় দিয়ে আসি্‌স বাপ’ এই বলে।
হাবল চৌধরি কথা রাখত সকলের । তার বাড়ির লোকের আপত্তিতে কান দিত না সে। বাড়ীর লোকেরা বুঝে গিয়ে ছিল যা বারন করলেও একাজ থেকে হাবলকে বিরত করা যাবে না। তবুও তার বৌদি তার প্রিয় দেবরটিকে বারণ করত অত দূরে একা একা অস্থি নিয়ে যেতে। হাবল হেসে উড়িয়ে দিত  বৌদির কথা।
এমনিই একবার হাবল চৌধরীদের গ্রামের এক ব্যাক্তির মৃত্যু হল ভোর রাতে। মৃতের আত্মীয় পরিজনদের আসতে আসতে মৃত দেহ দাহ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল।
হাবল চৌধরীকে তার বৌদি বলল, ‘ হাবল ভাই আমার এই ভর সন্ধেবেলাতে তুমি আর অস্থি নিয়ে বহরমপুরে অতদূরে যেও না’ ।
সে বলল সে তুমি চিন্তা কর না বৌদি, এখন তো সবে সন্ধে আমি এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসব।
এইবলে হাবল চৌধরী তার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভৈরবের তীরে বালুচরে যেখানে মৃত দেহ দাহ করা হয়েছে। এখন সেখানে মৃতের আত্মীয় পরিজনেরা দাঁড়িয়ে। মাটির হাড়িতে অস্থি ভরে নিয়ে তাকে লাল কাপড় দিয়ে বেঁধেছে তারা। তাঁরা হাবল চৌধরীর অপেক্ষাতেই ছিল। হাবল চৌধরীকে সাইকেলে চেপে আসতে দেখে অস্থি হাতে মৃতের আপনজনেরা এগিয়ে এল। হাবল চৌধরী তাদের সমবেদনা জানিয়ে অস্থির হাড়িটা রডে ঝুলিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল। হাবল চৌধরী জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে চলল। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। সাইকেল চালাতে চালাতে হাবল চৌধরী গলা ছেড়ে গান ধরল – ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ – গাইতে গাইতে হাবল চৌধরী অনেকটা পথ চলে এসেছে।
গাঁয়ের পথ, রাত হলেই ফাঁকা হতে থাকে। মাঝে মাঝে দু-একজনের সাথে দেখা হচ্ছে হাবল চৌধরীর। তাদের সকলেই প্রায় তার পরিচিত। হাবল চৌধরী যে অস্থি নিয়ে গঙ্গাতে বিসর্জন দিতে যায় এ কথা প্রায় সকলেই জানে। তদের মধ্যে দু একজন আবার হাবল চৌধরীকে ডেকে জিঞ্জাসা করে ‘ কি হল হাবু, আজ কে গেল’?
হাবল চৌধরীও তাদের উত্তর দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে সাইকেলে করে । এমনি করে সাইকেল চালাতে চালাতে বহরমপুরের কাছাকাছি চলে এসাছে প্রায়, এমন সময় হটাৎ হাবল চৌধরীর পাশ দিয়ে প্রচন্ড জোরে একটা বাতাস বয়ে গেল। সেই বাতাস যেন হাবল চৌধরীকে কিছু বলে গেল।
সে বাতাসের এতোই জোর ছিল যে হাবল চৌধরী সে কথা বুঝতে পারল না। সাইকেল সমেত পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল। কি ব্যাপার হল ভাবতে না ভাবতেই আবার একটা জোরে বাতাস তার কানের পাশ দিয়ে বয়ে গেল।
হাবল চৌধরী এবার স্পষ্ট শুনতে পেল কে যেন তার কানের পাশে ফিশ ফিশ করে বলছে ‘ আঁমার অঁস্থিটা আঁমাকে দিঁইয়ে দেঁ’ ।
অসীমসাহসী হাবল চৌধরীরও সেই আওয়াজে বুকের ভিতরটা হীম হয়ে গেল। তখন সে আরো জোরে জোরে সাইকেল চালাতে লাগল।
এবার তার কানের পাশে আরো জোরে বাতাশ বয়ে গেল। সেই হাওয়ার মধ্যে একটা কাটা হাত ভেসে এসে হাবল চৌধরী গালে সজোরে একটা চড় মারল। হাবল চৌধরী আবারও শুনতে পেল ফ্যাস ফ্যাস করে রাগে দাঁত কড়মড় করতে করতে কে যেন তাকে বলল - তোঁকে বঁললাম নাঁ আঁমার অঁস্থিটা আঁমাকে দিঁয়ে যাঁ।
চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে সাইকেল সমেত মাটিতে পড়ে গেল হাবল চৌধরী।
জ্ঞান ফিরলে সে দেখতে পেল পথের পাশে একটা গাছ তলায় সে শুয়ে আছেআবার তাকে ঘিরে দুজন মানুষ। তাদের একজনের হাতে বাংলা লন্ঠন ।
সেই বাংলা লন্ঠনের স্বল্প আলোতে হাবল চৌধরী দেখতে পেল তার সাইকেলটা উল্টে রয়েছে আর অস্থির সেই মাটির হাঁড়ি পথের মধ্যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হাবল চৌধরী ভয় ভয় চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখল মাটির হাঁড়ি ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেছে ঠিকই তবে সেই মাটির হাড়ির একটা ভাঙা টুকরোর মধ্যে অস্থিটা পড়ে আছে। যেন হাবল চৌধরীর দিকেই কটমট করে চেয়ে রয়েছে।
ওই লোক দুটি হাবল চৌধরীকে বলল বাবু চলেন আপনি আজ আমাদের বাড়ীতে থাকেন। আপনি আর যেন না যান অস্থি গঙ্গায় ফেলতে, কাল ভোরে ও কাজটা আমরা করবখন। এই বলে তারা হাবল চৌধরীর সাইকেলটা পথের থেকে তুলে নিয়ে এল।
লোক দুটির বাড়ি কাছেই ছিল। হাবল চৌধরী সেখানে কিছুখন বিশ্রাম করে ওদেরি একজনকে সাথি করে বাড়ি ফিরে যেতে চাইল। ওরা অনেক করে হাবল চৌধরীকে তাদের বাড়িতে থেকে যেতে বলল।
হাবল চৌধরী জানত যে তার বড় বৌদি সে না ফেরা পর্যন্ত শান্তি পাবে না, জেগে বসে থাকবে।
সে তাই গভীর রাতেই বাড়ি ফিরে এল। তার বৌদি তার মুখ থেকে সব কথা শুনে দুহাত জোড় করে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রনাম জানাল। তিনি ঠাকুর ঘর থেকে গঙ্গাজল নিয়ে এসে হাবল চৌধরীর গায়ে মাথায় ছিটিয়ে বললেন ‘ একমাত্র ঠাকুরই আজ তোমাকে রক্ষা করেছে ভাই । আজ থেকে তুমি প্রতিজ্ঞা কর যে আর কোনদিন তুমি অস্থি বিসর্জন দিতে যাবে না’।

হাবল চৌধরী প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিল। এঘটনার পর থেকে আর কোনদিনও সে অস্থি বিসর্জন দিতে গঙ্গায় যায়নি।