Tuesday 23 December 2014

বুকের গভীরে কার যেন ডাক আসে

মনের সাথে দীর্ঘ ২ ঘণ্টা দন্ধ করলো সত্য। একটু পরেই তার অসমাপ্ত জীবনের সমাপ্তি হবে। তাই মার কাছে শেষ চিঠিটা লিখতে বসলো সে। তার অসমাপ্ত জীবনের শেষ চিঠি।*****************************************************************************************************************************

জানো মা,


          যাবো কি? যাবো না? করতে করতে আজ চলেই যাচ্ছি। তুমি সেই ছোটবেলায় আমাকে বলতে, আমি নাকি খুব স্বার্থপর, মনে আছে? জানি তুমি মন থেকে বলতে না। কিন্তু আজ তোমার কথাটাই সত্যি হয়ে যাবে একটু পর। আমার একটা কথা প্রায় সবসময় মনে পড়ে, যেটা তুমি প্রায় ই আমাকে বলতে, আর যেটা আমার অনেক প্রিয় ছিল। ‘মায়ের কথা সবসময় ফলে, দেরিতে হলেও ফলে......দেখে নিস, তখন বুঝবি মায়ের কথা সত্যি হয়’। আমি স্বার্থপর, তোমার এই কথাটা আজকে ফলে যাবে মা। আমি স্বার্থপরের মতোই চলে যাবো একটু পরে। অনেক দূর, অজানা কোনো দেশে, না ফেরার কোনো দেশে। আমি জানি তুমি কাঁদছো আর ভাবছো ‘আমার মুখটা কি তোর একবারও মনে পড়লো না? একবারও চোখের সামনে ভেসে উঠলো না?’ উঠেছে মা। তোমার ছেলে এতোটাও নিষ্ঠুর না মা। এর আগে যতবার স্বার্থপরের মতো এই কাজটা করতে গিয়েছি ততোবারই তোমার মুখটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। তার সাথে বারবার কানে ভেসে এসেছে আমার সাথে দিদিদের ঝগড়ার চ্যাঁচামেচি আর চিৎকার করে তোমার কাছে আমার নালিশ দেওয়ার আওয়াজ। বারবার মনে পড়েছে কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ওদের সাথে খুনসুটির কাহিনীগুলো। জানি ওরাও হয়তো ভীষণ কষ্ট পাবে। খুনসুটি করার এমন মানুষ যে আর পাবে না। জানো মা আমি প্রতিবার আরও অনুভব করেছি, বাবার কষ্টটা। সবাই বলে সন্তানের লাশ নাকি পিতার কাছে সবচেয়ে বড় আর ভারী বোঝা। এই বোঝা বইবার কষ্ট নাকি পাহাড়সম। সবকিছুই আমার বারবার মনে পড়েছে মা, খুব পরিস্কার মনে পড়েছে। আর তাই এর আগে যতবারই স্বার্থপর হওয়ার চেষ্টা করেছি পারিনি। একবারও পারিনি, শুধু তোমাদের কথা ভেবে পারিনি। তবে আজ কেন জানি না নিজের কষ্টটাকে অন্য সবকিছু থেকে বড় লাগছে। অনেক বেশি বড় লাগছে মা। এই ছোট্ট শরীরে নিজের কষ্টের বোঝাগুলো আমি আর বইতে পারছি না। জানি তুমি ঠিক এখনও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বলবে, আরেকটু অপেক্ষা করতি বাবা, আরেকটু ধৈর্য ধরতি, দেখতি সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেছে। আগেও যেমনটি বলতে, ‘ঈশ্বর আছেন, তিনি সব ঠিক করে দিবেন, একটু অপেক্ষা কর’। ঈশ্বর আছেন কি নেই আমি জানি না মা, শুধু এটুকু জানি আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আর একটুও অপেক্ষা করতে পারছি না মা। এতদিন তো ধৈর্য ধরে ছিলাম, কিন্তু কিছুই কেন ঠিক হলো না মা? বরং হারানোর তালিকাটা আরও দীর্ঘ হলো। সাথে না পাওয়ার মাত্রাটাও দীর্ঘ হচ্ছিলো। তাই স্বার্থপরের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনো কিছুই দীর্ঘ করবো না। না হারানোর তালিকা, না দীর্ঘশ্বাসের মাত্রা, না কষ্টের বোঝা, না এই জীবন। জানি তোমাদের অনেক কষ্ট হবে। তবুও বলছি খুব বেশি কষ্ট পেও না মা।



বরঞ্চ ভেবে নিও আমার চলে যাওয়াটা তোমার জন্য ভালো হবে। তোমাকে কেউ আর কারণে অকারণে জ্বালাবে না। তুমি শান্ত হয়ে বসে থাকলে কেউ তোমাকে বিরক্ত করে বলবে না চুলে বিলি কেটে দিতে। নিজের পছন্দের জিনিস রান্না করানোর জন্য কেউ তোমাকে জোর করবে না। ছোট বাচ্চার মতো মুখ করে কেউ আবদার করবে না ভাত খাইয়ে দেওয়ার। অযথা তোমার সাথে কেউ রাগারাগি করবে না। মনে মনে রাগ করে হয়তো ঠিক করে নিবে, যে ছেলে আমার কথা না ভেবেই স্বার্থপরের মতো  চলে গেছে তার জন্য আমি দুঃখ করবো না।

দিদিদের বলে দিও ওরা আজ থেকে চলমান এক বিরক্তির হাত থেকে মুক্ত। কেউ ওদেরকে আর অযথা চিমটি দিয়ে ব্যাথা দিবে না। চুপ করে বসে থাকলে কেউ পিছন থেকে গিয়ে চুল খুলে দিবে না। কেউ যখন তখন সামান্য কারণে ঝগড়া করবে না। সাজগোজ করার পর কেউ বিরক্ত করার জন্য কানের কাছে প্যানপ্যান করবে না এটা বলে যে, ‘তোমাকে জঘন্য দেখতে লাগছে’। আজ থেকে ছোট একটা কাজ করার জন্য কেউ বড় ধরনের কোনো ট্রিট চাইবে না। ওদেরকে বলো ওরা যেন ভেবে নেয় আজ থেকে ওদের শান্তি।



বাবাকে বলো চার পায়ার ঐ খাটিয়াটা না বইলেও চলবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝাটা তিনি নিশ্চয় সহ্য করতে পারবেন না। আমায় নির্বোধের মতো কাজ করতে দেখে হয়তো রাগে গিজগিজ করতে গিয়েও পারবেন না। বাবাকে বলে দিও আমার চলে যাওয়া হয়তো তার জন্যও ভালো হয়েছে। তিনি এখন থেকে একটা চলমান দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত। আজকের পর থেকে কেউ উনার কাছে যখন তখন টাকা চাইবে না। অফিস থেকে পরিশ্রম করে ফিরে আসার পর কেউ উনাকে বিরক্ত করবে না অযথা। আজ থেকে আমার খামখেয়ালীপনা নিয়ে তাকে আর কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

আর আমি জানি আমার কোনো বন্ধুই হয়তো তাদের এই স্বার্থপর, বোকা, নেকু বন্ধুটার জন্য মন খারাপ করবে না কিংবা কাঁদবে না। তাদের আরও অনেক বন্ধু আছে তাদের দিনটাকে সুন্দর করার জন্য, তাদের আড্ডাগুলোকে জমিয়ে তোলার জন্য।

অনেক কিছুই তো লিখে ফেললাম দেখছি। আসলে তোমার সাথে শেষ কথা তো, তাই কথা ফুরোতেই চাইছে না। আর বেশি কিছু লিখবো না। আমার জন্য খুব বেশি কেঁদো না। ভালো থেকো মা। স্বার্থপর এই ছেলেটাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।

 ******************************************************************************

*******************************************************************************


এরপর মিনিট দশেক সময় অতিক্রম হলো। সত্য শেষবারের মতো প্রিয় মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করলো। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে মুখগুলো। ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা............ আরও ঝাপসা............

লিখেছেন - সত্যজিৎ রায়