Sunday 21 December 2014

অনন্য অপরাজিতা Ananya Aparajita

রাত ৩টা...খটখট করে যখন আমি ল্যাপীর কীবোর্ডে ঝড় তুলছি একরকম....ঠিক তখনি মাথার উপর একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া...
-কিরে ঘুমাবি না...???কি এতো কাজ করিস সারা রাত ধরে...।আমার ভাল্লাগে না,তোর জন্য আমিও সারা রাত ঘুমাতে পারি না ভেবে যে তুই ঘুমাস না...।
-মা...আমি কি বাচ্চা মেয়েটা আছি....বলতে পারো একটা বড়সড় মাল্টিন্যাশনাল কম্পানীতে জব করি...কাজ তো করতেই হবে তাই না...না হলে শুধু শুধু কি আর আমাকে টাকা গুলো দেবে বলো...যাও তুমি ঘুমাওগে...আমি এইতো আর ১০ মিনিট..।
মা আমাকে ছোট্ট করে আদর দিয়ে যায় আর বলে....
-যা ভালো মনে হয় কর তুই...কখোনো মানা শুনছিস তুই...???
মনে পড়ে যায় আজ থেকে ৪ বছর আগের কথা...বাবা আমাকে বলেছিলো..
“সারাদিন কম্পিউটারটার সামনে বসে কি করো...কাল দেখলাম সারা রাত বসে আছো ওটা নিয়ে...এই বাজে সময় নষ্ট না করে পড়তে পারোনা...???”অথচ কিনা আমি সেই সারা রাত ধরে করেছিলাম অ্যাসাইনমেন্ট যেটার লাষ্ট ডেট ছিলো পরের দিন...।
কাজ থেকে অন্য দিকে মন চলে যাওয়ায় আমি কফির তেষ্টা অনুভব করি....চলে যাই কিচেনে...গরম পানি করতে করতে ভাবি...........
আজ আমি সাকসেসফুল একটা মেয়ে....বলতে গেলে যার টাকার খুব একটা অভাব নাই....বাবা এখন রিটায়ার্ড...মা এখোনো একটা স্কুলে পড়ান,কতো মানা করেছি দরকার কি...বলে সময় কাটেনা রে...আমিও বাধা দেইনি...কারন আমাকে কেউ কোনো দিন বাধা দিক এটা আমিও পছন্দ করতাম না..।ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা মেয়ে ছিলাম,কিন্তু কোনো দিন বাবা মায়ের দেয়া এই স্বাধীনতাকে অপব্যাবহার করিনি...ভালো ফল যে পাইনি তানা...আবার কিছু আত্বীয় স্বজনের কথাও কম শুনতে হয়নি...।

২০১০ সালে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলাম মধ্যমানের একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে...২০০৬ এ যখন কোথাও চান্স পেলাম না...আশেপাশের মানুষজন কম কানাঘুষা করেনি...আরে তালুকদার সাহেবের মেয়েটা কোথাও চান্স পায়নি,পাবে কি করে সারাক্ষন এইভাবে স্বাধীনতা দিয়ে রাখলে মেয়ে তো বখে যাবেই...বাই দ্যা ওয়ে আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।

তারপর আর কি ভর্তি হলাম একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে,এবার একটু মনোযোগী হওয়া যাক পড়ার বিষয়ে ভেবে শুরু করলাম...।মোটামুটি ভালো রেজাল্ট নিয়ে আমার গ্রাজুয়েশন,পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম...।

পড়ার পাশাপাশি এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু করতাম,ঠিক সবাই যেভাবে করে সেভাবে না....আড়ালে গোপোনে....ঈদের সময় ২০টা বাচ্চাকে জামা দিসিলাম টাকা তুলছি টিচারদের কাছ থেকে,শীতে কাপড় দিতাম, রাতের বেলা বের হয়ে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জোগাড় করতাম যেনো কেউ না দেখে....ওগুলো ওই বাচ্চাদের দিয়েছিলাম অন্যকারোর হাত থেকে...

ভার্সিটির কোনো প্রোগ্রাম...প্রায় সব সমন্বয় গুলো করে দিতাম আমি....।এভাবে একজন পরিচিতো মুখ হয়েছিলাম আমার ইউনিতে....।

এবার চাকরি খোজার পালা...আমার মনে আছে আমাকে অনুরোধ করতে হয়নি আমাদের ডিপার্টমেন্টাল হেডটিচারকে...উনি নিজেই আমার হয়ে সুপারিশ করলেন একটা ভালো দেশীয় কোম্পানীতে...ভালোই চলছিলো....বাট কিভাবে যেনো জানি না একদিন আমার অফিস ডেস্কের উপর একটা চিঠি দেখি সকালে অফিসে গিয়ে...খুলে দেখি আমি এখন যে কোম্পানীটায় চাকরি করি সেখান থেকে আসছে....তারা আমাকে ডেকেছে আমার সব কাজ এর ওভার ভিউ দেখে...আমি সেবার বেষ্ট এমপ্লয়ার অব দি ইয়ার হয়েছিলাম আমার আগের অফিসে....ওরা আমাকে ছাড়তে চায়নি,ইভেন এরাও না যেখানে আমি এখন আছি....

ওদের সাথে একটা ছোটখাট কনভার্সেসন করে জানতে পারি ওরা আমাকে নিতে চায় এবং স্যালারী আমার এখনকার বেতোনের ৩ গুণ...সকল সুযোগ সুবিধা সহ...জয়েন করে ফেলি বাবার অনুমতি নিয়ে...সত্যি কথা বলতে কি আমি যে কখনো কলিগদের বা বসের কাছে একটুকুও খারাপ কিছু পাইনি তা না...কিন্তু আমি ভুলে গেছি...কারোন বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে এটা আমি জানতাম যে তোমাকে যদি একটা ছেলের মতো করে বাঁচতে হয় তাহলে সব কিছু সেভাবেই নাও...তোমাকে বাইরে দিয়ে একজন মেয়ে হিসেবে দেখে বাজে কমেন্ট করবে আর তুমি নিজেকে ভেতর থেকে একজন ছেলে হিসেবে নিজেকে দেখে তার প্রতিবাদ করবে...আমি আমার প্রতিটা সত্যের প্রতিবাদ আর আমার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে এখন একজন সক্ষম সফটওয়ার ইন্জিনিয়ার...

আজ বাবা আমার সাফল্যে খুশি,মা কোনোদিন অতিরিক্ত হাসিখুশি দিয়ে তার সুখী থাকাটা প্রমান করতে নারাজ...তাই আমি তার চোখে মুখে দেখি সেই গর্ব যেটা সব বাবা মা আশা করে একজন সন্তানের কাছ থেকে । সে ছেলে অথবা মেয়েই হোক...।

আমি এখন আর সেই সব প্রতিবেশীদের কানাঘুষা শুনিনা...তারা এখন বলে তালুকদার সাহেবেরর মেয়েটা মানুষ হবে জানতাম...বাইরে বাইরে না ঘুরলে দুনিয়া সম্পর্কে জানবে কি করে...???

খুব হাসি পায় এই পিএনপিসি করা লোকগুলোকে দেখলে...মনে হয় এদের জবাব মুখে না,কাজে দেখাতে পেরেছি আমি...।

আমার আত্বীয় স্বজনরা এখন বলে তো কি হয়েছে চান্স পাসনি তখন...শাপে বর হয়েছে....কোনো উত্তর দেইনা তাদের আমি...।

শুধু চোখ বন্ধ করে আমার ঈশ্বর আর আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া বাবা মা কে মনে করি আমার আজকের এই সাফল্যের জন্য...।

লিখেছেন - তনুশ্রী তালুকদার