Monday 15 December 2014

আমার চিলেকোঠা Amar Chilekotha

আমাকে যখন পিঁড়িতে করে নামানো হলো ঘর থেকে আমার দাদা কানের কাছে ফিসফিস করে বলছিলো,কিরে জানিস না একদিন আমাদেরই তোকে তুলে নামাতে হবে,এতো ওজন কেন বাড়িয়েছিস....নিজের কথা না হয় না ভাবলি একবার আমাদের কথা তো ভাবতে পারতি...।
এই আমার ছাদনাতলায় আগমন।বুক ভরা চাপা কষ্টের মাঝেও আমি ফিক করে হেসে ফেলি আর সর্ন্তপনে দাদার মুখের দিকে তাকাই...ভাইটার আমার মুখটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না;নিজে স্বাভাবিক থাকা আর আমাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য যে এই তিক্ত রসিকতা সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম।

কি নিষ্ঠুর পৃথিবী তাই না...???পেলেপুষে বড় করলো ওরা আর কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো একটা পাগল।এসে নিজের দুহাত প্রশস্ত করে বলে কিনা,সমস্ত পৃথিবী ঘুরে যখন তুমি ক্লান্ত হবে তখন আমার এই চিলেকোঠা তোমার জন্য।

আরি!!!ধুর তাই আবার হয় নাকি???

জানি না কি হয় কি হয় না,আর ৫টা মেয়ের মতো প্রেম কাকে বলে করে দেখতে পারিনি,তাই বেচারা যা বললো তাই বিশ্বাস করে নিলাম।বিয়ের ১ মাস আগে থেকে কল্পনা করতে শুরু করলাম একটা বিস্তৃত চিলেকোঠার।

নতুন নতুন প্রেম বা অনুভুতি যেটাই বলা হোক না কেন আমি কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করলাম।দস্যি আমি লাজুক হলাম।মা’কে রান্নায় সাহায্য করতে শুরু করলাম।বাড়ির সবাই আমার উপর অবাক।সব থেকে বেশি আমার দাদাটা...যে কিনা এক কাপ চা বানাতে বললে উত্তর দিতাম বানিয়ে খা।আর সেই আমি এখন নিজে থেকে দাদাকে চা বানিয়ে ডেকে বলি নে চা খা।

সবাই আমার উপর খুশি যে আমি অলস একটা মেয়ে থেকে কর্মঠ মেয়ে হয়ে উঠছি,শ্বশুর বাড়ি গিয়ে হয়তো কোনো কথা শুনতে হবে না।এতো কিছু আমার কানেও যায় না...তখন আমার মধ্যে অন্য স্বপ্ন।

এক বিকেলে আমি বসে আছি বাড়ির ছাদে,মা আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বললো দেখ একটা ছেলের বায়োডেটা।আমার প্রাথমিক ভাবে ভালোই লেগেছে,তোর বায়োডেটা পছন্দ হলে আমরা কথা বলবো।আমি কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিলাম।কিন্তু চেয়ে রইলাম অনেক দুরে চলে যাওয়া ওই রাস্তাটায়।

বুকের মধ্যে কেমন যেন ধক করে উঠলো,তবে কি আমার যাওয়ার সময় হয়ে এলো,প্রপোজাল তো আগেও এসেছে কই এমন তো লাগে নি।মুহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার বাজার করে ফিরে বাজারের ব্যাগটা আমার হাতে দেয়া,আমার চুলগুলো বেধে দেয়ার সময় মায়ের চিৎকার,চুলগুলো কি বানিয়ে রেখেছিস।আর দাদার আমার কান ধরে টান দেয়া।আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম...।সেই কান্না আমার ছাদ ছেড়ে সেই রাস্তা ছাড়িয়ে অনেক দুর চলে গেলো কিন্তু কেউ যেনো বুঝতে পারলো না দীর্ঘশ্বাসের কান্নাটা কোত্থেকে ভেসে আসছে।তাই রোজকারের মতো সব মেয়ের কান্নার আওয়াজ বাতাস হয়েই ভাসলো।

আমি চোখ মুছে কাগজটা খুললাম।খুলেই কেমন চমকে গেলাম এ আবার কেমন নাম???“অনুকাব্য”বাকীটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।সত্যি বানিয়ে বলবো না স্বপ্নে যেমন ভাবতাম তাকে সত্যিই সে তেমনটা ছিলো।আমি আর না করিনি।বলেছিলাম দেখা করবো যদি তারা চায়।

একটা কফিশপে বসে আছি আমি,চামচটা দিয়ে টুংটাং শব্দ করে যাচ্ছি কাপটায়।তার আসার কথা ৪.১৫তে,এখন ৪.২১বাজে।হন্তদন্ত হয়ে একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখলাম,ছেলে বলাই ভালো,পুরুষ পুরুষ লাগছে না।মানে এখনো বেশ ছোট ছোট।একটা পোলো শার্ট,একটা কালো জিন্স পরা ছেলে ঘড়ি দেখতে দেখতে দৌড়ে এসে আমাকে বললো“তরী???”“হু”“স্যরি ৪.২১বেজে গেলো”“ঠিক আছে,এটা কোন ব্যাপার না,বসুন।”বসতে বসতে ছেলেটা বললো“আপনি নিশ্চই কফির অর্ডার দিয়ে ফেলেছেন,আর এক কাপ প্লিজ আমার

সাথে,হ্যা???”হেসে ফেললাম আমি “হুমম অবশ্যই,চা কফি জিনিসটা আমার বরাবরই প্রিয়”যদিও নার্ভাস ছিলাম তাও না দেখানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু সে আমার থেকে আরো একধাপ উপরের পাবলিক,আরো নার্ভাস।

“তরী,তোমাকে কিছু কথা বলবো,একদম সরাসরি।আমি কোন ঝামেলা রাখতে চাই না তোমার আমার মাঝে যদি আমাকে তোমার পছন্দ হয়।আমি যখন ক্লাশ টেনে পড়ি তখন আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম,ওটাকে হয়তো ভালোবাসা বলতো না,বলতে পারো আবেগ।ওর জন্য অনেক কিছু করেছি।আমার ক্লাশমেট ছিলো সে। আমি নিজের পড়া নষ্ট করে তাকে ম্যাথ বুঝিয়েছি সে অংকে কাঁচা ছিলো বলে।সেও হয়তো আমার সাথে অভিনয় করতো যে সে আমাকে ভালোবাসে।আফসোস আমার সেদিন হয়েছিলো যেদিন আমি জানতে পারি সে আমাকে ইউজ করে শুধু তার স্বার্থর জন্য।পরে শুনতে পারি তার আর একটা বুয়েটের ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো।যেদিন আমি ঘটনা জানতে পারি সেদিন আমি আমার মোবাইলের সিম ভেংগে ফেলে দেই।আর কোনোদিন যোগাযোগ করিনি তার সাথে...।এবার বিশ্বাস করা তোমার ব্যাপার।”

আমি এক নিঃশ্বাসে সব কথা গুলো হজম করি।করতে কষ্ট হয় কিছুটা তাও করি।পরে নিজে চিন্তা করলাম ক্লাশ টেনের ঘটনা কি খুব বেশি মুখ্য ঘটনা?

বাসায় এসে চুপচাপ অনেক চিন্তা করে মা’কে জানালাম আমার পছন্দ হয়েছে।মা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এক করলো বাড়িশুদ্ধ সব মানুষকে...।

আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কি হঠাৎ করে আমার সাধারন বাড়িটা উৎসবের বাড়িতে রুপান্তরিত হলো।চারিদিকে আলোর রোশনাই,সবার দৌড়াদৌড়ি।

আমিই শুধু ঘরের এক কোনে বসে স্বপ্ন দেখি আর কাঁদি।এক অজানা ভয় আশংকা আমাকে গ্রাস করতে থাকে মুহুর্ত থেকে মুহুর্তের মধ্যে।অনুকাব্যের সাথে আমার ফোনে কথা হতে থাকে,সে আমাকে সত্যি সত্যি প্রতিদিন তার চিলেকোঠার স্বপ্ন দেখায়।আমিও সেই স্বপ্নে বিভোর।সত্যি বলতে কি কোথায় হানিমুনে যাবো,আমার বাসার বেডরুমের পর্দার রং কি হবে,ডায়নিং টেবিল,খাট এগুলো হাতিল না অটবি থেকে কিনবো সেইসব কথা হতো।যেগুলো প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেমের শুরুর দিকে ভাবতে থাকে সেগুলো আমি ভাবতে শুরু করলাম আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে।

অনুকাব্যের সাথে আজকে আমার বিয়ের ৪ বছর পূর্ন হলো।সব ভালোবাসা উজার করে ভালোবেসেছে সেই পুচকি ছেলেটা।সত্যি এতো ভালোবাসা যায় নাকি...???ওকে এখোনো জানানো হয়নি আমাদের চিলেকোঠায় নতুন অতিথী আসছে।কি করে বলি সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না।তারপরও সব কিছুর পরেও আমি পরম নিশ্চিন্ত সেই চিলেকোঠায়।