Saturday 27 September 2014

আমার চাচাতো ভাই নিপুন

আমার চাচাতো ভাই নিপুনের সাথে আমার সম্পর্ক অন্য সব ভাইবোনদের চেয়ে ভালো।। নিপুনের পরীক্ষা শেষ হলে ও চলে আসতো আমাদের বাসায়।। আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমি চলে যেতাম তাদের বাসায়।।

যাই হোক, আপনাদের আজকে একটা কাহিনী বলবো, আমার এবং নিপুনের সম্পর্কে।। যদিও ঘটনাটি আমাদের পুরো পরিবারের সাথেই ঘটেছিলো তবে ভুক্তভোগী ছিলাম আমিই বেশি।।

ডিসেম্বর মাস।। নিপুনের পরীক্ষা শেষ।। আমারও পরীক্ষা শেষ।। তবে নিপুনের ঢাকায় কিছু
কেনাকাটা বাকি ছিল তাই সে এবার ঢাকায় চলে আসে।। বিকেলের বাসে রওনা দেয়, আমাদের বাসায় এসে পৌঁছায় রাত ৯ টার দিকে।।

বাসায় ঢুকেই সে দৌড়ে বাথরুমে চলে যায়।। কাউকে কোনও কথার সুযোগ না দিয়ে।। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তার পায়ের ফাঁক দিয়ে রক্ত পড়ছে।। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।।

যাই হোল, কিছুক্ষণ পর সে যখন বাথরুম থেকে ফিরে আসে তখন সে একদম স্বাভাবিক।। সবার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে।। আম্মা, আব্বাকে বলল পরীক্ষার কথা।। মিনিট বিশেক পর সে আমাকে ডেকে আমার বেডরুমে নিয়ে গেলো।।

অনেকদিন পর নিজের প্রিয় মানুষটাকে দেখে খুশি খুশি লাগছিল।। ঘরে ঢুকেই নিপুন বিছানায় চলে গেলো।। বিছানায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, “নিশি, তোর সমস্যা না হলে লাইট টা নিভিয়ে দে তো!! চোখে লাগছে!!”

আমি নিপুনের কথা শুনে অবাক হলাম।। তবে লাইট টা অফ করে ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম।। তাছাড়া রুমের জানলা খোলা, সেখান দিয়ে পাশের স্ট্যান্ডের লাইট থেকে আলো এসে পড়ছে।। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নিপুন, পরীক্ষা কেমন দিলি?? এবার ফার্স্ট হবি??”

এটা হল নিপুণকে খোঁচানোর একটা মুক্ষম হাতিয়ার।। সে প্রতি বছরই খুব ভালো পরীক্ষা দেয়, কিন্তু কয়েক মার্কসের জন্য দ্বিতীয় হয়ে যায়।। গত ৬ বছর যাবত এটা চলে আসছে।।
আমার খোঁচাটা ধরতে পারলো নিপুন।। ম্লান হেসে বলল, “এবার প্রথম হবো রে!! আমি জানি!!”

কিছুটা অবাক হলাম।। কারণ এই প্রশ্নের উত্তরে নিপুন কোনও উত্তর দেয় না।। বরং অনেক খেপে যায়।। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইয়া, তোর মনটা ভালো তো??”

নিপুন একটু হেসে বলল, “আরেহ হ্যাঁ গাধী, মন ভালো।। একটু ক্লান্ত আছি এই যা!!”

আমি কিছু বললাম না।। চুপচাপ বসে রইলাম।। হটাত আমাকে চমকে দিয়ে নিপুন বলল, “তোকে ছোট বেলায় অনেক জ্বালাতাম না?? মাথায় গাট্টা মারতাম।। মাঝে মাঝে ঘুষি দিয়ে দৌড় মারতাম।। তুই তো হাউমাউ করে কাদতি!! তুই আসলেই অনেক বোকা রে!! তবে শোন, আমি এগুলো তোকে শুধু খেপানর জন্য করতাম।। এমনিতে আমি আমার বোনটাকে অনেক ভালোবাসি।।”

আমার বিস্ময় তখন চরমে!! নিপুনের কাছ থেকে এসব জীবনেও আশা করি নি আমি।। নিপুন অনেক রাফ এন্ড টাফ একটা ছেলে।। আবেগকে পাত্তা দেয় না কখনো।। সারাদিন মেতে থাকে মজা মাস্তিতে।। অথচ তার মুখে এসব কথা।।

আমাকে আর ভাবতে হল না।। হটাত ঝড়ের বেগে আমার রুমে এসে মা প্রবেশ করলো।। আমাকে বলল, “নিপুন কই??”

আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।। আমার সামনে বসে আছে ছেলেটি, আর মা বলছে নিপুন কই?? এর কি উত্তর দিবো আমি??

মার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিপুনের দিকে তাকালাম।। আসলে নিপুন যেখানে বসে ছিল সেখানে তাকালাম।। এইবার ভয়ঙ্কর একটা ধাক্কা খেলাম।। নিপুন যে কিনা মাত্রই আমার সামনে বসে ছিল, এখন সেই জায়গাটি ফাঁকা।। মা বলল, “লাইট নিভানো কেন??” বলে বতি জ্বালিয়ে দিলো।। আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না।। শুধু তাকিয়ে রইলাম।।

পরবর্তীতে যা জানতে পারলাম।। মা-বাবা বসে টিভি দেখছিল, এমন সময় আমার মেঝো চাচা ফোন দেয়।। উনি ফোন দিয়ে বলেন নিপুন যেই বাসে ছিল সেই বাস এক্সসিডেন্ট করেছে।। বাসের ৪ জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যায়।। নিপুনের পায়ের এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে একটা রোদ ঢুকে যায়।। ডাক্তাররা বলেছে অবস্থা আশংকা জনক।। যে কোনও সময় খারাপ খবর আসতে পারে।।

এই কথা শুনে মা আমার রুমে দৌড়ে আসে।।

আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।। মা আমাকে ধরে ধরে উনাদের বেডরুমে নিয়ে যান।। সেখানে যাওয়া মাত্রই একটা ফোন আসে মার মোবাইলে।। মেঝো চাচা জানান, নিপুন মারা গেছে।।

আসলে কি জানেন, আমি আমার ভাইটাকে অনেক মিস করি।। আর এমন একটি ঘটনা আমার জীবনটাকে উলটপালট করে দেয়।। আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক সময় লাগে।।

তুই যেখানেই থাকিস নিপুন, ভালো থাকিস।।

****সংগৃহীত