Sunday 6 July 2014

স্বপ্নে প্রাপ্ত Swapne prapti

সোহেল লেহস


গত তিন মাস ধরে লিনা নামের এক মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি। অসম্ভব রকমের মিষ্টি গলা লিনার। সে গান গায়। যখন আমাকে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শোনায় আমার বুকের ভেতর চিন চিন করে ব্যাথা করে। যার গলার স্বর এত শ্রুতি মধুর সে না জানি দেখতে কত সুন্দর! লিনাকে আমি কখনও সামনা সামনি দেখিনি।
আধুনিক যুগে মানুষের সাথে পরিচয়ের অনেক মাধ্যম হয়েছে। মোবাইলের কথা না হয় বাদই দিলাম, ইন্টারনেট এখন অনেক সহজলভ্য। ফেস বুক, স্কাইপ, ভাইবার আরও কত কি করে মানুষের সাথে মানুষের কথা হচ্ছে, পরিচয় হচ্ছে, এমনকি বিয়ে সাদীও হয়ে যাচ্ছে। লিনার সাথে আমার কিন্তু এসবের কোন কিছুতেই পরিচয় হয়নি। তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল খুবি সনাতন পদ্ধতিতে। লিনাকে আমি পেয়েছিলাম স্বপ্নে।

না, স্বপ্নে পাওয়া কোন ঔষধের মতন নয়। মানুষ নাকি দুঃস্বপ্ন বার বার দেখে। যারা দেখে তাঁরা প্রায় রাতেই একই রকম স্বপ্ন দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে জেগে উঠে। আমার বেলায় ঘটনা হয়েছে উল্টো। স্বপ্নে দেখলাম লিনাকে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলে। তাঁর সাথে মজার মজার গল্প করলাম। সেদিন খুব আরামের লম্বা ঘুম হল। এর পর লিনাকে দেখতে লাগলাম প্রায় রাতেই। এখন ঘুমাতে যাবার আগে মনে প্রানে প্রার্থনা করি যেন লিনাকে দেখি। সব সময় অবশ্য তাঁর দেখা মেলে না। কালকে এত আশা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম লিনাকে দেখব বলে। কিন্তু দেখলাম ইয়া শুকনা হাড় জিরজিরে টেকো মাথার এক লোক লুঙ্গী কাছা মেরে বসে আছে। আর ফোকলা দাঁতে আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে।

এখানে একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা হল স্বপ্ন হলেও লিনার চেহারা আমি কখনই পরিষ্কার দেখতে পাই না। আবছা আবছা দেখি। হাত পা ফর্সা আর মাথায় ঘন দীঘল কুন্তল অত টুকুই দেখি। তবে তাঁর কথা বার্তা চমৎকার। স্বপ্নে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে,
তুমি খাইছো?
খেলামতো। সন্ধ্যায় বাসায় এসেই খেয়েছি।
কি দিয়ে খাইলা?
আপা পাবদা মাছ রান্না করেছে। খুব মজা হয়েছে।
আমাকে না দিয়াই খাইলা? খারাপ লাগলো না?
কি করব বল? সারাদিন না খেয়ে দৌড়া দৌড়ি করেছি। ক্ষুধায় হুঁশ জ্ঞান ঠিক ছিল না। বাসায় এসে শুধু গাব গাব করে গিলেছি।
আহারে! এত দৌড়াও কেনো? নিজের প্রতি যত্ন নিতে পার না? অসুখে পড়বাতো।
ইচ্ছা করেইতো আর দৌড়াই না, দুলাভাইয়ের বিজনেসে হেল্প করি। খালি এখানে সেখানে পাঠায়। আমি এক মুহূর্ত বসলেই তাঁর পিত্তি জ্বলে যায়।
তোমার দুলাভাই একটা পাজি মানুষ।
একটু পাজিতো অবশ্যই, তবে মানুষ ভাল। যাহোক তুমি খেয়েছ?
না।
আরে খাওনি কেন? কত রাত হয়েছে জান?
তুমি আসবা তারপর এক সাথে খাব চিন্তা করছিলাম। কিন্তু তুমি এসেতো আর আমার জন্য ওয়েট কর নাই। স্বার্থপরের মতন খেয়ে ফেলছ।
সরি। তুমি আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবা এটা জানলে কি আর আমি খেতাম?
হয়েছে, এখন ভাল মানুষ সাজতে হবে না।
বললামতো সরি। এই যে প্রতিজ্ঞা করলাম এখন থেকে তুমি খেয়েছ কিনা জিজ্ঞেশ না করে আমি খাব না।
কিভাবে জিজ্ঞেশ করবা? গাধু, স্বপ্ন ছাড়া আমাকেতো দেখই না।
তাও অবশ্য কথা। যাহোক এখন যাও ভাত নিয়ে আস। খেতে খেতে আমার সাথে গল্প কর।
না, এখন খাব না। আব্বু আসুক, আব্বুর সাথে খাব। তুমি এখন একটা গান শুনবা?
শুনব।
লিনা গান ধরে, তোমার এই ছলনা, ভুলবো না, কাজ নেই আর আমার ভালবেসে...এটুকু গেয়ে লিনা খিল খিল করে হাসে। আমার মন উথাল পাথাল হয়ে যায়। হোক না স্বপ্ন, তারপরও এরকম দারুন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আমি জিজ্ঞেশ করি, তুমি মিলার ওই গানটা গাইতে পারবা?
কোন গানটা?
ডিস্কো বান্দর?
ধুর! অই সব গান আমি গাই না। তাঁর থেকে ওর 'আজ ঘুমিয়ে তাঁরা গুলো চুপি চুপি কথা কয়...' এইটা শুন।
আচ্ছা।

লিনা গান ধরে। গানের মাঝ খানে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে লিনা বলে,
দাড়াও পল্টুকে নিয়ে আসি।
ঠিক আছে যাও।
পল্টু লিনার ছোট ভাই। চৌদ্দ মাস বয়স। পল্টুকে নিয়ে এসে তাঁর সাথে খেলা করে লিনা,
এইটা কে রে ...এইটা কে...এইটা পল্টু সোনা...এইটা পুতু পুতু পল্টু সোনা।
পল্টুর পেটে মুখ লাগিয়ে ভুর ভুর করে শব্দ করে লিনা। পল্টু ই ই ই করে হাত পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে হাসে।

বাস্তবে কোন দিন প্রেম করিনি। জানি জানি কেও বিশ্বাস করবে না। এই কলি যুগের পোলাপান প্রেম করে নাই কিম্বা করে না তা বম্বে ব্লাড টাইপের মতনই বিরল। পৃথিবীর অতি অল্প কিছু মানুষের দেহেই নাকি এই টাইপের রক্ত পাওয়া যায়। একটু সরল সিধা এবং হাবাগোবা টাইপ ছিলাম বলে কখনও প্রেম করা হয়ে উঠেনি। প্রেম করলে আবার কে কি মনে করে এই ভয়ও ছিল। আমি দুলাভাইয়ের খাই পড়ি। তিনি ভীষণ রগ চটা মানুষ। প্রেম করি জানতে পারলে প্যদানি খাওয়ারও ভয় আছে। এর থেকে স্বপ্নের প্রেমই ভাল। কাওকে রাগানোর কোন ভয় নেই।

যত দিন যায় আমার সাথে লিনার প্রেম গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল। মাঝে মধ্যে টুক টাক ঝগড়াও হত। ঝাল মিষ্টি ঝগড়া আর কি।

এই তুমি আমার জন্য ফুল আন না কেন?
ফুল দিয়ে কি করবা?
কি করব মানে?? তোমার ভেতর কি এক ফোটা রোমাঞ্চ ফোমাঞ্চও নেই নাকি?
আমি বলি, ওহ আচ্ছা। বুঝেছি। ঠিক আছে গোলাপ এনে দেব।
ঠোট উল্টে লিনা বলে, যাও লাগবে না।

......ইত্যাদি। এই ধরণের ঝগড়ায় প্রেম আরও কঠিন হয়। ঘরকুনো বলে আমার বিশেষ খ্যাতি আছে। এই অদ্ভুত প্রেমের কারণে আমি বলতে গেলে বাসা থেকে বের হওয়া একদমই ছেঁড়ে দিলাম। যতক্ষণ বাসায় থাকি ঘুমাই কিম্বা ঘুমানোর চেষ্টা করি। ঘুমের ভেতর যেহেতু তাঁর সাথে দেখা হয় সেহেতু পারি না দিনের চব্বিশ ঘন্টাই ঘুমাই, সেটা সম্ভব নয়। আবার সব সময় ঘুমও আসতে চায় না। ঘুমের ঔষধ খেলে এক ধাক্কায় ঘুম পার হয়ে যায়। স্বপ্নের টিকিটিরও দেখা মেলে না। তাই পারতপক্ষে ঘুমের ঔষধ খাই না।

দুলাভাই সন্দেহ প্রবণ মানুষ। আমাকে এত ঘুমাতে জেগে তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন,
কি রে, সমস্যা কি তোর? এত ঘুমাস কেন?
আমি বলি,
জানি না দুলাভাই। খালি ঘুম আসে।
জানস না? আমারে আঙ্গুলচোষা দুধের বাচ্চা পাইছ? কল্কেতে দিনে কয়বার টান দেও?
রেগে গেলে দুলাভাই তুই থেকে তুমিতে নেমে আসেন। আমি জিবে কামড় দিয়ে বলি,
ছি ছি দুলাভাই, এসব কি বলেন? ওই জিনিশ আমি ছুই না।
ছোউ না? তুমি একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা? যদি শুনি তুমি গাঞ্জা ধরছ পিটাইয়া পাছার ছাল ছুটাইয়া ফালামু।
আমি বলি, দুলাভাই ঐ জিনিশ করার টাইম কই আমার? সারাদিনই তো থাকি আপনার সাথে।
তাইলে এত মটকা মাইরা ঘুমাও কেন? হাত টাত মারার অভ্যাস নাইতো?
লজ্জায় আমার কান লাল টক টকে ফজলি আম হয়ে যায়। আমি আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করি,
না না এই সব কি বলেন দুলাভাই?
হুমমম...ভাল পোলা আছ, ভাল হইয়াই থাক। নজর জানি অন্য দিকে না যায়। দুলাভাই আবার পত্রিকা পড়ায় মন দেন।

দিনে দিনে লিনার জন্য আরও পাগল হতে লাগলাম। এক সময় মনে হতে লাগল রিয়েল লাইফে লিনাকে আমার খুবি দরকার। রাস্তা ঘাটে অন্য কোন মেয়ে চোখে পড়লেও এখন আমি চোখ ঘুরিয়ে নেই। লিনা কষ্ট পাবে। লিনাকে কষ্ট দিয়ে আমি কিছু করব না। আমি জানি জিনিশটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নে দেখে একজনের প্রেমে পরে যাওয়াটা শুধু হাস্যকরই নয়, সেটা মানসিক রোগেরও লক্ষণ। কে জানে আমি হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কোন মতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছি না। মনে হচ্ছে লিনার সাথে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমি লিনার জন্য। লিনা আমার জন্য। সেটা এখন বাস্তব কিম্বা অবাস্তবেই হউক।



চট্টগ্রাম যাচ্ছি একটা কাজ নিয়ে। এস আলমের বাসে উঠেছি। ঘড়ি দেখলাম, সকাল ১০টা ২০। বাস ছাড়বে সাড়ে দশটায়। দীর্ঘ পথের যাত্রায় বাসে উঠে সবার আগে যে কাজটা আমি করি সেটা হল আশেপাশে বাসের ভেতরটা ভাল করে দেখে নেই। কত ধরণের মানুষই না বাসে উঠে! মানুষ পর্যবেক্ষণ করার মধ্যেও এক ধরণের আনন্দ আছে।

আমার পাশের সিট এখনও খালি। মনে হচ্ছে সিটটা খালিই যাবে। বাস ছাড়ার আর বেশি দেরি নেই। আমার পাশের সারির সিটে বসেছে অল্প বয়সী এক যুগল। সাথে বছর এক/দেড়েকের এক বাচ্চা। মেয়েটা নিঃসন্দেহে রুপবতী। হাল্কা পাতলা লম্বা গড়ন। সুতির হলুদ সেলওয়ার কামিজ পড়েছে। ভীষণ ফর্সা বলে হলুদ রঙের সাথে তাঁর সতেজ ত্বক মিলে গিয়ে অদ্ভুত এক আভার সৃষ্টি করেছে। মেয়েটার পাশে বসা ভদ্রলোকও বেশ সুদর্শন, লম্বা চউরা দেহ, মাথা ভর্তি এলমেল চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। দেখে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ভদ্রলোক মিনারেল ওয়াটার না কি যেন আনার জন্য একটু আগে বাস থেকে বের হয়েছেন।

এমন সময়ে মেয়েটির কোলের বাচ্চা কান্না শুরু করে দিল। বাচ্চার কান্না থামানোর জন্য তাকে দোল দিতে দিতে মেয়েটি বলতে লাগল,
এটা কে...কে এটা...এটা আমার পল্টু সোনা...আমার পল্টু সোনা কাঁদেরে...।
আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। আমার হাত পা প্রায় অবশ হয়ে এল। এই গলার স্বর আমার অতি চেনা। আমি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ভিতরে থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। এক সময় মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল,
লিনা?
মেয়েটি এমনভাবে চমকে ঊঠল যে হাত ফসকে কোলের বাচ্চা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল।
সায়েম? কাঁপা গলায় মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেশ করল।
আমি কোন মতে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ ।
এমন সময় পানি নিয়ে ভদ্রলোক ফেরত এসেছেন। বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে কোলে নিয়ে বলতে লাগলেন,
আমার বাবুটা কেন কাঁদে...আমার দুষ্টু বাবু কাঁদেরে।

মেয়েটি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিছুই ঘটেনি এরকম একটা ভাব করে সে বরের সাথে কথা বলতে লাগল। আমি মাথা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আমার চব্বিশ বছরের জীবনে পৃথিবী কখনও এর থেকে থেকে বেশি শুন্য মনে হয়নি।