Tuesday 24 June 2014

দর্জির কাপড় চুরি

 অনেক অনেক পুরনো দিনের কথা। এক শহরে বাস করতো এক দর্জি। দর্জি মানে যারা জামা কাপড় সেলাই করে। কোনো কোনো এলাকায় দর্জিকে খলিফাও বলে। তো এই দর্জির কাজ ছিল ভালো। খারাপ যেটা ছিল তা হলো- চুরির অভ্যাগ। যে-ই জামা কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার দিত, তার কাপড় থেকে সে কিছু অংশ চুরি করত। এই চুরি করাটা ছিল তার একটা বাহাদুরি। যদিও এই বাহাদুরির কোনো ভালো দিক নেই। চুরি তো চুরিই। সে যত ছোটই হোক কিংবা বড়। কাপড় চুরি করাটাকে সে দক্ষতা এবং শিল্পনৈপুণ্য বলে মনে করত। সবাই জানত দর্জি চুরি করে। সবাই তাই চেষ্টাও করেছে তার কাপড় চুরি ধরতে কিন্তু কেউই পারেনি। সবার সামনেই সে কাপড় কেটে নেয় তবুও না। অথচ জামা তৈরি করে দেয়ার পর সে সবাইকে তার চুরি করা কাপড়ের টুকরো দেখিয়ে বেড়াত।
 এত সূক্ষ্মভাবে সে চুরি করত যে কোনোভাবেই ধরা যেত না। লোকজন দর্জির কাছে কাপড় নিয়ে যাবার আগে বন্ধুবান্ধবকে
বলে যেত কোনোভাবেই আমি চুরি করার সুযোগ দেব না, কিন্তু কোনো লাভ হত না। সবার জামার কাপড় থেকে চুরি করা টুকরোগুলো জমিয়ে কাস্টমারদের দেখাত-কত নিপুণ শিল্পের শিল্পী সে, যাকে বলে চুরি শিল্পী! কিন্তু সবার চোখের সামনে মাপ নিয়ে কাপড় কাটার পরও কীভাবে যে চুরি করত, বহু চেষ্টা করেও কেউ বুঝতে পারত না। আসলে দর্জি তার কাস্টমারকে কোনো না কোনোভাবে সম্মোহিত করে ফেলত। কখনো কথা বলতে বলতেই সম্মোহিত করত, কখনো গাল-গল্প করে, কখনো কৌতুক শুনিয়ে ইত্যাদি বিচিত্র উপায়ে। তার এই চালাকিটাকে এভাবে কেউ চিন্তাই করত না বরং সবাই মনে করত দর্জি বেশ গল্পপ্রিয় এবং খুব রসিক মানুষ। গল্পের মধ্যে কাস্টমার বুঁদ হয়ে যেত, তাদের মন আর দর্জির টেবিলে থাকত না। এই ফাঁকে দর্জি তার কাজ সেরে নিত।

এক তুর্কি যুবক ছিল বেশ সম্পদশালী। চালাক চতুরও ছিল। গাড়ি ঘোড়া বা টাকা-পয়সার কোনো অভাব ছিল না তার। একদিন কফি হাউজে বসে সে তার বন্ধুদের নিয়ে কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। কথায় কথায় দর্জির কাপড় চুরির প্রসঙ্গ উঠল। তুর্কি যুবক বলল: আমার কাছ থেকে চুরি করতে পারবে না। বন্ধুরা চ্যালেঞ্জ করল। যুবক রাজি হলো। বলল- কী বাজি ধরতে চাও বল। বন্ধুরা বলল- তোমার ওই ঘোড়া। ঘোড়াটি ছিল বেশ সুন্দর এবং তাগড়া। যুবক বলল সমস্যা নেই, কে বাজি ধরবে, আস। যদি আমি হেরে যাই তো আমার ঘোড়া দিয়ে দেব, আর আমি জিতলে আমার ঘোড়ার মতো আরেকটি ঘোড়া কিনে দিতে হবে।

বন্ধুরা জবাব দেওয়ার আগেই একটা গরিব ছেলে বলে উঠল 'আমি ধরব বাজি'। কিন্তু শর্ত হলো আমার তো ঘোড়াও নেই, টাকা পয়সাও নেই। যদি আমি হেরে যাই তাহলে আমি তোমার কাজ করে দেব। তুর্কি যুবক রাজি হয়ে গেল।
পরদিন সকাল বেলা। তুর্কি যুবক জামা সেলাই করার জন্যে চোর দর্জির কাছে কাপড় নিয়ে গেল। দর্জি কিন্তু কফি হাউজে গতকালের সব ঘটনাই শুনেছিল। সে কারণে যুবককে দেখার সাথে সাথেই মনে মনে বলল: হায়রে সহজ সরল যুবক! এখন থেকেই ধরে নিতো পার তোমার ওই চমৎকার ঘোড়াটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। এমনভাবে তোমাকে সম্মোহিত করব যে নিজেও টের পাবে না কখন তুমি হাওয়া হয়ে গেছ।

যুবকটাকে দর্জি খুব সম্মানের সাথে স্বাগত জানাল। তুর্কি যুবক বেশ সতর্ক। তার পুরো মনোযোগ দর্জি ওপর। যুবক তার দামি কাপড়টা টেবিলের ওপর বিছালো এবং বলল: জনাব দর্জি! এই কাপড় দিয়ে আমার জন্যে একটা গাউন বানাবে। এমনভাবে বানাবে পরলে যেন রণাঙ্গনের সেনাপতির মতো দেখায়। আরো কোন কোন ডিজাইন তার পছন্দ সেসবের বর্ণনা দিয়ে দর্জিকে কাপড় বুঝিয়ে দিল সে।

দর্জি জানত যুবক গল্পের খুব ভক্ত। কাপড় হাতে নিয়ে এ ভাঁজ ও ভাঁজ করার ফাঁকে সে শুরু করে দিলো হাসির গল্প। গল্প শুরু করার আগে সে অবশ্য যুবককে বলে নিয়েছিল 'তোমাকে উৎফুল্ল করার জন্যে আমি আমার আগের কাস্টমারদের কিছু মজার গল্প তোমাকে শোনাব। আমি নিশ্চিত তোমার ভালো লাগবে'।

দর্জি রসিয়ে রসিয়ে বেশ মজা করে গল্প শুরু করল। যুবক দর্জির গল্পে ডুবে গেল এবং হাসতে শুরু করল। এমনিতেই যুবকের চোখ দুটো ছিল ছোট, হাসতে শুরু করলে চোখ একদম কোটরে ঢুকে যেত, দেখাই যেত না। প্রথম গল্প শুনেই যুবক এমনভাবে হাসল যে তার চোখই বন্ধ হয়ে গেল আর এই ফাঁকে দর্জি তার চুরির কাজটা সেরে নিল।

যুবক গল্প শুনে এতোই মজা পেল যে দর্জিকে আরেকটা গল্প শোনাবার জন্যে অনুরোধ করল। দর্জি যুবকের অনুরোধ রাখল এবং আরেকটা গল্প শোনাল। এই গল্প শুনে যুবক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, হাসতে হাসতে একেবারে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। যুবক ভাবতেও পারেনি এই গল্পের ভেতরে কী ঘটে যাচ্ছে। তার যে সাড়ে বারোটা বেজে যাচ্ছে মনেও ছিল না তার।

দর্জি এতো কাপড় চুরি করেছে যে নিজেই অনুতপ্ত হয়ে মনে মনে বলতে লাগল-তুর্কি যুবক বুঝতে না পারলেও আল্লাহ তো এই চুরি সহ্য করবে না! অনেক হয়েছে, আর না! আর কোনো গল্প বলা ঠিক হবে না। যুবক কিন্তু তারপরও পীড়াপীড়ি করতে লাগলো গল্প বলার জন্যে। দর্জি কোনোভাবেই রাজি না। যুবককে সে বোঝাতে চেয়েও পারেনি যে এই গল্প বলে সে কী ফায়দা লুটেছে। যুবকের দিকে তাকিয়ে সে বলল: হে যুবক! আর গল্প বলবো না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তাছাড়া আমার আর গল্পও জানা নেই। কিন্তু যুবক নাছোড়বান্দা। অবশেষে দর্জি তাকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে বলল: ক্ষান্ত দাও হে বোকা যুবক! তুমি যদি চাও আরো গল্প বলি, তাহলে তোমার গাউন আর তোমার গায়ে লাগবে না, ছোটো হয়ে যাবে, তুমি কি বুঝতে পারছো কী বলছি? তুর্কি যুবকের এবার ঘুম ভাঙল যেন। কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হঠাৎ অট্টহাসি দিয়ে উঠল।
দর্জি জিজ্ঞেস করলো; হাসছো কেন?
যুবক বললো: 'আর হাসব না। এবার আর হাসব না। নিজের বোকামির কথা ভেবে হেসেছি। আমি তো সেই শুরু থেকেই বাজিতে হেরে বসে আছি। আমার এই সুন্দর আর দামি ঘোড়াটা তো সেই প্রথম গল্পেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। অথচ আমি বিন্দুমাত্র টেরও পেলাম না।'